বৃহস্পতিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা
ক্ষুব্ধ প্রবাসীরা বলেছেন

দাবি দুটি দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ

লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র

মার্কিন কংগ্রেসের টম ল্যান্টোস মানবাধিকার কমিশনের ব্রিফিংয়ে উত্থাপিত দুটি দাবিকে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসীরা ‘দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র’-এরই অংশ বলে অভিহিত করেছেন। ওই ব্রিফিংয়ে র‌্যাবকে বিলুপ্ত ও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশকে নিষিদ্ধের দাবি তোলা হয়েছিল।

মঙ্গলবার ডেমোক্র্যাটিক পার্টির কংগ্রেসম্যান জেমস পি ম্যাকগভার্ন ও রিপাবলিকান পার্টির কংগ্রেসম্যান ক্রিস্টোফার স্মিথের উদ্যোগে এক ভার্চুয়াল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। তারা কংগ্রেসের টম ল্যান্টোস মানবাধিকার কমিশনের কো-চেয়ার। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধির বক্তব্য শোনেন কংগ্রেস সদস্যরা। কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ব্রুস ভোগেন অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। মানবাধিকার রক্ষায় কংগ্রেসের ভিতরে ও বাইরে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এ কমিশন।

‘বাংলাদেশে গুম’ করা বা হওয়া নিয়ে এ শুনানিতে অংশগ্রহণকারীরা দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার চেয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের নিষিদ্ধের দাবি করায় তা রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসীরা। মহলবিশেষের রাজনৈতিক স্বার্থে এ শুনানির আয়োজন করা হয় বলেও গুঞ্জন উঠেছে তাদের মধ্যে। কারণ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ৩০ বছরের অধিক সময় ধরে কর্মরত বাংলাদেশি সেনাদের ভূমিকা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত।

আলোচনার আগের দিন সোমবার যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম শহীদুল ইসলাম সভার আয়োজক দুই কংগ্রেসম্যানকে চিঠি দেন।

এতে গুমের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান তুলে ধরে রাষ্ট্রদূত লেখেন, নিখোঁজের সব ঘটনাকে গুম হিসেবে বর্ণনা করার মাধ্যমে সরকারের ভাবমূর্তি ও অর্জন ক্ষুন্ন  করা উদ্বেগের। কারণ ‘ঘটনার শিকারে’ পরিণত হওয়া লোকজন ফিরে আসার মাধ্যমে প্রমাণিত ‘তথাকথিত গুমের’ অভিযোগ মিথ্যা। কিছু দুষ্কৃতকারী র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম ভাঙিয়ে অপহরণে যুক্ত আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেশাগত দক্ষতা আর বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুন্ন করার উদ্দেশ্যে এ ধরনের অপরাধমূলক তৎপরতা চালানো হচ্ছে। কংগ্রেসের টম ল্যান্টোস মানবাধিকার কমিশনের ব্রিফিং বিষয়ে জর্জিয়া স্টেটের সিনেটর শেখ রহমান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শান্তি রক্ষার সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুকে জড়ানো উচিত নয়। সারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের ভূমিকার প্রশংসা রয়েছে। মার্কিন ফেডারেল প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তা (বাণিজ্য মন্ত্রণালয়) ড. জিয়া করিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন-সমৃদ্ধি যারা পছন্দ করে না, একাত্তরের পরাজিত শত্রুদের প্রতিভূ হিসেবে পরিচিতরাই এহেন নির্জলা মিথ্যাচার করছে। এমনভাবে শুনানির আয়োজন মতলবি রাজনীতিরই নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।

উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশি সংগঠনসমূহের জাতীয় মোর্চা ‘ফোবানা’র চেয়ারম্যান জাকারিয়া চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বরাবরের মতোই যারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পছন্দ করে না, বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলুক তা চায় না তেমন একটি মহলেরই কান্ড এটি। তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলেই এমন নির্জলা মিথ্যাচার এবং শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানাচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অব ম্যারিল্যান্ডের গ্লোবাল ক্যাম্পাসের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. ফাইজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পেট ব্যথা করলে তার চিকিৎসা করতে হয়। কিন্তু সে স্থলে মাথা কেটে ফেলার প্রয়োজন নেই। যদিও তেমন দাবিই করা হয়েছে কংগ্রেসের ওই ব্রিফিংয়ে। গুটিকয় অফিসারের কারণে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করার দাবি কখনই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। এমন দাবি যারা উচ্চারণ করছেন তারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

আমেরিকা-বাংলাদেশ অ্যালায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট এম এ সালাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে কোনো অভিযোগ নেই। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী একটি মহল নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রের তকমা লাগিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা হাতিয়ে নেওয়ার। কংগ্রেসের এ ব্রিফিং তেমন ষড়যন্ত্রেরই একটি নগ্ন প্রকাশ। যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি আবদুল কাদের মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ইমেজ প্রশ্নবিদ্ধ করার গভীর ষড়যন্ত্রের একটি অংশ হচ্ছে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করার দাবি। বাংলাদেশের নিরাপত্তারক্ষীরা কাজ করছেন জাতির বৃহত্তর স্বার্থে। কাদের মিয়া আরও বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যারা চায়নি, বাংলাদেশের অগ্রগতি যাদের সহ্য হচ্ছে না তারাই চালাচ্ছে এমন জঘন্য অপপ্রচার।

বহুবছর যাবৎ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি সেনা সরবরাহকারী রাষ্ট্র। এর বিনিময়ে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় বাংলাদেশের। অর্থাৎ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের মতোই এও একটি অবলম্বন। এই সময়েও নয়টি শান্তিরক্ষা মিশনে ৭ হাজারের মতো বাংলাদেশি রয়েছেন।

মঙ্গলবার টম ল্যান্টোস মানবাধিকার কমিশনের ব্রিফিংয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, গুম নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান কী তা এ আলোচনার আগে রাষ্ট্রদূতের চিঠি থেকে স্পষ্ট। অনেকের আশঙ্কা, সরকারের এ নিয়ে জবাবদিহির কোনো ইচ্ছাই নেই। তিনি বলেন, কভিড-১৯ মোকাবিলা নিয়ে সারা বিশ্বে তুমুল সমালোচনা হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে এ নিয়ে নিজেদের মত প্রকাশ করতে গিয়ে লেখক মুশতাক আহমেদ ও কার্টুনিস্ট আহমেদ কিশোরের যে পরিণতি হয়েছে তা আমাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বলেন, বাংলাদেশে গুমের একটি মামলারও বিচার হয়নি কেন তা একটি বড় প্রশ্ন। এশিয়ান মানবাধিকার কমিশনের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেন,র‍্যাবকে বিচারহীনতার আওতায় রেখে কর্মকান্ড চালাতে দিয়ে ভিন্নমতের কণ্ঠ রোধ করা হচ্ছে। বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম তার ভাইসহ গুমের শিকার সবার খোঁজ জানতে চান। টেক্সাস থেকে ১১ বার নির্বাচিত ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসওম্যান শিলা জ্যাকসন লি প্রশ্ন করেন, এ পরিস্থিতির উত্তরণে নাগরিকসমাজকে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করতে পারে? শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগের বিষয়ে কী করা যেতে পারে?

জবাবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন রবার্ট এস কেনেডি হিউম্যান রাইটসের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যানজেলিটা বায়েনেস বলেন, এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র অভিযুক্তদের নিয়োগের (শান্তিরক্ষা) সময় তার ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। এমনকি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে।

তবে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করার দাবির মাধ্যমে সংশ্লিষ্টরা মূলত বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ সীমিত করার ফন্দি এঁটেছেন বলে মনে করেন রাজনৈতিক সচেতন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশিরা।

সর্বশেষ খবর