রবিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বিলীন হচ্ছে ঝাউবন, হুমকিতে সৈকত

জিন্নাতুন নূর, কক্সবাজার থেকে ফিরে

বিলীন হচ্ছে ঝাউবন, হুমকিতে সৈকত

পৃথিবীর দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতকে তীরবর্তী যে ঝাউবনগুলো বছরের পর বছর ধরে রক্ষা করে এসেছে সেগুলো আজ বিলীন হতে চলেছে। সাগরের  জোয়ার-ভাটায় প্রতিনিয়ত ঢেউয়ের আঘাতে উপড়ে যাচ্ছে উপকূলের রক্ষাকবচ এসব ঝাউগাছ। এর ফলে হুমকিতে পড়েছে সমুদ্রসৈকতও। ভাঙনের কবলে ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে সৈকত। সাগর সরে আসছে শহরের দিকে। পরিবেশবাদীরা আশঙ্কা করছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে শুধু যে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়, কক্সবাজার বিমানবন্দরও ঝুঁকির মুখে পড়বে।

সরেজমিন ঘুরে কক্সবাজারে বিমান বাহিনীর ঘাঁটির সামনে থেকে শুরু করে কবি নুরুল হুদা চত্বর হয়ে সামনে এগিয়ে সুগন্ধা পয়েন্ট পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার সৈকতের ক্ষতিগ্রস্ত ঝাউবনের দৃশ্য নজরে আসে। কয়েক বছর আগেও সৈকতজুড়ে যে ঝাউবনের সারি দেখা যেত তা কমতে কমতে এখন বিলীন হওয়ার পথে। সৈকতের কলাতলী থেকে নাজিরারটেক পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে সাধারণত পর্যটকরা ভিড় জমান। উদ্বেগজনকভাবে সৈকতের প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়েই তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। সৈকতের ভাঙন ঠেকাতে জিও ব্যাগ ব্যবহার করা হলেও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন এতে একদিকে যেমন অর্থের অপচয় হচ্ছে অন্যদিকে সৈকতের ভাঙন ঠেকাতে এটি খুব বেশি কাজে আসছে না। আবার ঢেউয়ের ধাক্কায় জিও ব্যাগও ভেসে যাচ্ছে।

কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুধু জিও ব্যাগ দিয়ে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত রক্ষা করা সম্ভব নয়। পরিবেশবাদীরা জানান, পাকিস্তান আমলে কলাতলীতে কোনো হোটেল ছিল না। কলাতলী পাহাড় পর্যন্ত সমুদ্রসৈকত ছিল। কিন্তু এখন সৈকতের চেহারা বদলে গেছে। সমুদ্রসৈকতে জোয়ারের ১ কিলোমিটার পর্যন্ত ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়ায় কোনো স্থাপনা তৈরির সুযোগ নেই। এ জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। কিন্তু এখানে সরকারি-বেসরকারি অনেক স্থাপনা তৈরি হয়েছে। অনেক ঝাউগাছ এরই মধ্যে লবণ দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। এসব এলাকায় প্রভাবশালীরা পরিবেশ সংশ্লিষ্ট অনুমোদন ছাড়াই অনেক হোটেল তৈরি করেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সৈকতের ওপর।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কক্সবাজারের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও মানবসৃষ্ট কারণে  সৈকতের ঝাউবন বিলীন হচ্ছে। হুমকিতে পড়েছে সমুদ্রসৈকত। আমরা সৈকতে নারিকেল গাছ লাগানোর কথা বলেছিলাম। কারণ এর শিকড় মাটির গভীরে যায়। যা ঝাউগাছের ক্ষেত্রে যায় না। বরং অল্প পানি ও বাতাসে ঝাউগাছ ভেঙে পড়ে। সব মিলিয়ে আমরা আশঙ্কা করছি কক্সবাজার বিমানবন্দরও এর প্রভাবে বিনষ্ট হয়ে পড়বে। এরই মধ্যে সমুদ্র বিমানবন্দরের কাছে চলে এসেছে। সৈকত রক্ষায় আমাদের পরিবেশ সংশ্লিষ্ট আইনগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। আবার সৈকতে উঁচু আকারের হোটেল তৈরি হলে সৈকতের বালি সরে যাবে। এদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। এ ছাড়া সমুদ্রে প্রচুর বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সেদিকেও নজর দিতে হবে। স্থানীয়রা জানান, এবারের বর্ষা মৌসুমের অস্বাভাবিক জোয়ারের কারণে ভাঙন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। ঢেউয়ের ঝাঁপটায় সরে যাচ্ছে বালু। ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সৈকতের শূন্য পয়েন্টে থাকা গণ-শৌচাগারও। সৈকতের ডায়াবেটিক হাসপাতাল থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার পর্যন্ত হাঁটার রাস্তা তলিয়ে গেছে। মূলত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় বর্ষায় ঢেউয়ের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সৈকত। আবার সমুদ্রের ঢেউয়ের ঝাঁপটা ও অব্যাহত বালু ক্ষয়ের কারণে দীর্ঘ সৈকতজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য উপড়ে পড়া ঝাউগাছ।  ঢেউয়ের ঝাঁপটায় গাছের মূল থেকে বালু সরে যাওয়ায় এসব গাছ উপড়ে পড়েছে। এই ঝাউগাছের অনেকগুলো আবার স্থানীয় গাছচোর সিন্ডিকেট নিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে সাগরের ঢেউয়ে ভেসে গেছে অনেক গাছ। ধারণা করা হচ্ছে- গত এক দশকে প্রায় লাখখানেক ঝাউগাছ উপড়ে গেছে। একই কারণে সৈকতের সাগরলতা ও অন্যান্য স্থাপনা ঝুঁকিতে রয়েছে। এ অবস্থায় সৈকতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দা ইকবাল ফারুক প্রতিদিন সকালে সৈকতে হাঁটতে আসেন। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগে সৈকতে যে পরিমাণ ঝাউগাছ ছিল তা এখন আর নেই। এমনকি সাগরও এখন অনেক এগিয়ে এসেছে। এমন চলতে থাকলে আর কয়েক বছরে সাগর শহরের ভিতর ঢুকে পড়বে। এদিকে সৈকতের ভাঙন ঠেকাতে ‘পরিবেশ ও পর্যটনবান্ধব প্রতিরক্ষা বাঁধ’ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ জন্য প্রায় ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাঙন রোধে পর্যটন ও পরিবেশবান্ধব প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের তথ্যমতে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭২-৭৩ সালে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের নাজিরারটেক, সমিতিপাড়া, ডায়াবেটিক হাসপাতাল, লাবণী, কলাতলী, দরিয়ানগর, হিমছড়ি, উখিয়ার ইনানী, সোনাপাড়া, টেকনাফের বাহারছড়া, মহেশখালীপাড়া এবং সাবরাং উপকূলের প্রায় ৪৮৫ হেক্টর বালুচরে ১২ লাখ ঝাউগাছ লাগানো হয়েছিল। এ ছাড়াও ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালে ১৮৫ হেক্টর বালুচরে দুই লাখের বেশি ঝাউগাছ লাগানো হয়। কিন্তু বর্তমানে এসব ঝাউবন হুমকিতে রয়েছে।

 

সর্বশেষ খবর