রবিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

নেতাদের কাছে যেতেই খুন

মির্জা মেহেদী তমাল

নেতাদের কাছে যেতেই খুন

হৃদয় হোসেন, সাদ্দাম হোসেন ও নাজমুল হোসেন। বয়স তাদের ১৬ থেকে ১৯। তিন বন্ধু। কদিন ধরে তাদের মন খুব খারাপ। পকেটে টাকা নেই। চোখের সামনে তাদের বয়সের ছেলেরা সাঁই সাঁই করে মোটরবাইক চালায়। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের কাছে সেই বাইকারদের ভীষণ কদর। মিটিং-মিছিলে বাইকারদের ডাক পড়ে। এটা বাদেও নেতাদের ছেলেপেলে প্রয়োজন হলে সেই বাইকার গ্রুপকেই স্মরণ করে। এসব দেখে মনের ভিতর জেদ চাপে সেই তিন বন্ধুর। তারাও পরিকল্পনা নেয় প্রথমে তারা বাইক কিনবে। লোকজনের চোখে পড়বে। বাইক কেনার পরিকল্পনা করলেও নেই তাদের সেই রকম টাকা। তবে উপায় কী? নিজেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালায়। একজন বলে, টাকা রোজগার করতে হবে। কিন্তু কীভাবে তিনটা বাইকের টাকা তারা জোগাড় করবে? হঠাৎ তাদের মাথায় এলো, তারা অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করবে। সেই টাকা দিয়েই বাইক কিনে শহর ঘুরে বেড়াবে। এমন সিদ্ধান্তের পর মাথায় এলো নতুন সমস্যা। কাকে অপহরণ করবে? বড় কাউকে তারা পারবে না। তাহলে কোনো বাচ্চাকেই অপহরণ করতে হবে। এরপর তারা চিন্তা করে কোন বাচ্চাকে। তাদের মাথায় ঘুরছে তখন দুটি বাচ্চা। এলাকার রুপমের ছেলে রোহান ও তোতা মিয়ার ছেলে রহমদের মধ্যে যে কোনো একজনকে অপহরণের পরিকল্পনা করে। কিন্তু রহমের বয়স বেশি হওয়ায় তাকে অপহরণের চিন্তা বাদ দেয়। পরে রোহানকে অপহরণের ব্যাপারে তারা তিনজন একমত হয়। কিন্তু এরই মধ্যে হৃদয় অপহরণের কাজটি করে ফেলে। ঘটনাটি ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানার বড়বাকা এলাকার।

গত ২৮ আগস্ট সকালে শিশু আল-আমিন বাড়ির সামনে কাঁচা রাস্তার ওপর বাইসাইকেল চালানোর জন্য বের হয়। প্রায় এক ঘণ্টা পার হলে আল-আমিন বাড়িতে ফিরে না আসায় তার মা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। পরবর্তীতে বাড়ির আশপাশে ও সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ না পেয়ে পরদিন আল-আমিনের বাবা শহিদুল ইসলাম মানিকগঞ্জের সিংগাইর থানায় গিয়ে নিখোঁজ জিডি করেন। এরই মধ্যে একটি নম্বর থেকে আল-আমিনের বাবার কাছে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরে ৩১ আগস্ট সকালে পরিবারের সদস্যসহ প্রতিবেশীরা আল-আমিনের সন্ধানে বেরুন্ডি গ্রামের চকে টেমা মিয়ার পরিত্যক্ত ভিটায় খোঁজ করতে থাকে। ওই ভিটার মাঝখানে বাঁশঝাড়ের মধ্যে শিশুটির পরনের গেঞ্জির অংশ এবং প্যান্ট দেখতে পায়। সেখানে মাছির আনাগোনা দেখতে পায়। সন্দেহ হওয়ায় বাঁশ পাতা সরিয়ে মাটি খুঁড়ে সাদা রঙের একটি প্লাস্টিকের বস্তা দেখতে পান। পরে সেটি বের করে আল-আমিনের মৃতদেহ পান। এ ঘটনায় মামলা হয় থানায়। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ছায়া তদন্ত শুরু করে। ক্লুলেস এ খুনের ঘটনাটি তদন্ত করতে গিয়ে স্থানীয় লোকজনকে জেরা করে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। কিন্তু খুনের বিষয়ে কোনো তথ্য পায় না। এক পর্যায়ে তদন্তকারীরা খোঁজ নেন ওই এলাকায় কাদের উপস্থিতি ছিল। এমন করে বেশ কয়েকটি নাম তারা সন্দেহের তালিকায় নেন। এক পর্যায়ে রাজবাড়ী এবং মানিকগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করা হয় সেই তিন বন্ধুকে। তারা পুলিশকে জানায়, অপহরণের পরিকল্পনা ছিল অন্য এক শিশুকে। কিন্তু হৃদয় অপহরণ করে আল-আমিনকে। আল-আমিনকে বন্যার পানি দেখানোর কথা বলে হৃদয় স্থানীয় সাপের ভিটায় (বৃহৎ বাঁশঝাড়) নিয়ে যায়। সেখানে নাজমুল আগেই অবস্থান করছিল। তারা দুজন প্রথমে আল-আমিনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার পর নাজমুলের কাছে থাকা প্লাস্টিকের বস্তার মধ্যে লাশ ঢুকিয়ে ফেলে। আল-আমিনের গেঞ্জি ও প্যান্ট মুক্তিপণ আদায়ের প্রমাণ হিসেবে খুলে রাখে। লাশের বস্তাটি কাছাকাছি জায়গায় প্রায় হাঁটুপানিতে ডুবিয়ে রেখে একটি মুরগির লিটারের (বর্জ্য) বস্তা দিয়ে চাপা দিয়ে চলে যায়। তখন নাজমুলের ফোন থেকে হৃদয় সাদ্দামকে ফোন দিয়ে জানায়, কাজ শেষ। ঘটনার পরে আল-আমিনের ব্যবহৃত সাইকেল দিনের বেলায় হৃদয় ও নাজমুল লুকিয়ে রাখে এবং একই দিন দিবাগত রাতে হৃদয়দের বাড়ির পশ্চিম পাশে পুকুরে ফেলে দেয়। পরে গত ৩০ আগস্ট সকাল ৬টায় হৃদয় কোদাল নিয়ে সাপের ভিটায় গিয়ে পানি থেকে একা আল-আমিনের লাশটি তুলে পাশেই শুকনো জায়গায় মাটিতে গর্ত করে পুঁতে রাখে। পরিকল্পনামাফিক সাদ্দাম ঘটনার দিন নতুন সিম সংগ্রহ করতে না পারার কারণে আল-আমিনের বাবার সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারে না।  তাদের পরিকল্পনা ছিল শিশুটিকে হত্যার পর নতুন সিম থেকে শিশুর স্বজনদের ফোন দিয়ে মুক্তিপণ আদায় করবে। কিন্তু সাদ্দাম ঘটনার দিন নতুন সিম সংগ্রহ করতে না পারার কারণে আল-আমিনের বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। তাই তারা মুক্তিপণও চাইতে পারেনি। মুক্তিপণ চাওয়ার আগেই স্থানীয়রা শিশুটির মৃতদেহ পেয়ে যাওয়ায় তারা এলাকা ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তারা পালানোর জন্য প্রথমে মানিকগঞ্জ থেকে সাভারের একটি হোটেলে ওঠে। সেখানে হোটেল বয়ের ফোন থেকে ওই শিশুর বাবার কাছে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চায় হৃদয়। কিন্তু তারা ভয়ে ছিল যে কোনো সময় ধরা পড়বে। তাই মুক্তিপণ চাইলেও তারা ওই দিন সাভার থেকে যশোরের বেনাপোল সীমান্তে চলে যায়। তারা চেয়েছিল সেখান থেকে অবৈধভাবে ভারতে পালিয়ে যাবে। কিন্তু ভারতে পালাতে না পেরে সেখান থেকে রাজবাড়ীতে পালিয়ে যায় তারা। সেখানে আত্মগোপনে থাকার চেষ্টা করলেও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে পিবিআইর জালে ধরা পড়ে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর