মঙ্গলবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ছয় মিনিটে আট লাশ

মির্জা মেহেদী তমাল

ছয় মিনিটে আট লাশ

সাদা রঙের মাইক্রোবাসটি শহরের আঁকাবাঁকা পথে ছুটে চলছে। তার পিছু নিয়েছে নীল রঙের অপর একটি মাইক্রোবাস। হঠাৎ  পেছনের চলন্ত মাইক্রোবাসটির ডান দিকের সাইড দরজা খুলে যায়। এক যুবক খোলা দরজা দিয়ে মাথা বের করে দিয়েছে। এক হাতে ভারী অস্ত্র। অপর হাত দিয়ে ভিতরের সিট ধরে আছে। একই সময়ে চালকের বাম দিকে বসা আরেক যুবকও জানালা দিয়ে দেহের অর্ধেক বের করে বসেছে। তার হাতেও ভারী অস্ত্র। হঠাৎ তাদের অস্ত্রগুলো হিংস্র হয়ে ওঠে। সামনে ছুটে চলা মাইক্রোবাস লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। সামনের মাইক্রোটির পেছনের গ্লাস ভেঙে যায়। চাকা ফুটো হয়। বেশিদূর যেতে পারেনি। সাদা মাইক্রোবাসটি থেমে যায়। অস্ত্রধারীদের বহন করা নীল মাইক্রোবাসটি পাশ কাটিয়ে সামনে গিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড়ায়। দ্রুতগতিতে ৩/৪ জন যুবক নীল মাইক্রোবাস থেকে নেমে আসে। প্রত্যেকের হাতেই স্বয়ংক্রিয় ভারী অস্ত্র! তারা সাদা মাইক্রোবাস ঘিরে ফেলে। অস্ত্রের ট্রিগারে চাপ দেয়। ম্যাগাজিনের গুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত ট্রিগারেই থাকে আঙ্গুল। সাদা মাইক্রোবাসের ভিতরটা ততক্ষণে রক্তে ভেসে গেছে। একজন আরেকজনের ওপর মুখ থুবড়ে পড়েছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। একজন দরজা খুলে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। পারেননি। মাত্র ৬ মিনিটেই মাইক্রোবাসে পড়ে থাকে ৮টি লাশ। ২১ বছর আগে চট্টগ্রাম শহরের বহদ্দারহাটের বহদ্দারবাড়ির সামনে ঠিক এভাবেই ফিল্মি কায়দায় আট খুনের ঘটনা ঘটেছিল। দিনের আলোয় শত শত লোকের সামনে হত্যাকান্ড ঘটিয়ে অস্ত্রধারীরা নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। তৎকালীন সরকারসমর্থিত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী বহনকারী মাইক্রোবাস এই হামলার শিকার হয়। জামায়াত শিবিরের ক্যাডাররা এই হামলা চালায়। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এ সময় বাকলিয়ায় ছাত্রলীগের একটি অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন। ২০০০ সালের ১২ জুলাই এ সংঘটিত নজিরবিহীন এই হত্যাযজ্ঞে চট্টগ্রামকে পরিণত করেছিল আতঙ্কের নগরীতে। জামায়াত শিবিরের এই নৃশংসতাকে অনেকেই ২৫ মার্চ কাল রাতের নৃশংসতার সঙ্গে তুলনা করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াত শিবিরের এই তান্ডবলীলায় মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। দিনের বেলায় একটি মাইক্রোবাস দিয়ে আরেকটি মাইক্রোবাসকে ধাওয়া করে ধরে ব্রাশফায়ার করে আট খুনের ঘটনাটি নজিরবিহীন বলে মনে করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফিল্মি স্টাইলে এমন হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় পুলিশ ও গোয়েন্দারাও হতবাক। শত শত মানুষের সামনে রক্তাক্ত হওয়া চট্টগ্রামের খবর জানতে তখন পত্রিকা অফিসগুলোতে একের পর এক ফোন আসতে থাকে। এ ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের একজনের ভাই আনোয়ার হোসেন বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানার কালামিয়ার বাজারে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের এক সমাবেশে যাওয়ার পথে ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা ব্রাশফায়ার করে। এতে ছাত্রলীগের ছয় নেতা, তাদের মাইক্রোবাসের চালক ও একজন অটোরিকশার চালক নিহত হন। ঘটনার আট বছর পর ২০০৮ সালের ২৭ মার্চ মামলাটির রায়  দেন চট্টগ্রামের দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ একরামুল হক চৌধুরী। রায়ে শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ হোসেন খান, মো. আলমগীর কবির ওরফে বাট্টা আলমগীর, মো. আজম ও মো.  সোলায়মানকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন। এ ছাড়া, আরও তিনজন শিবির ক্যাডার হাবিব খান, এনামুল হক ও আবদুল কাইয়ুমকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। যাবজ্জীবন দন্ডাদেশ পাওয়া আসামিরা এখনো পলাতক। মৃত্যুদন্ডাদেশ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সাজ্জাদ হোসেন খান ভারতের কারাগারে, অন্য তিনজন দেশের কারাগারে বন্দী। পরবর্তীতে হাই কোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ মৃত্যুদন্ডাদেশ অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স) ও আসামিদের আপিলের ওপর শুনানি শেষে চার আসামিকে খালাস দিয়ে রায় দেয়। গোয়েন্দারা জানতে পারে, ২০০০ সালের ১২ জুলাই চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানার কালামিয়ার বাজারে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের এক সমাবেশ ছিল। নাসিরাবাদ শেরশাহ কলোনি থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সেই সমাবেশে যোগ দিতে মাইক্রোবাসে করে রওনা হন। বেলা ১১টায় তারা কলোনি থেকে বের হওয়ার পর থেকেই নীল রঙে একটি মাইক্রোবাস অনুসরণ করতে থাকে। ছাত্রলীগের মাইক্রোটি শিবির অধ্যুষিত বহদ্দার হাট অতিক্রম করার সময় নীল মাইক্রো থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। ছাত্রলীগের মাইক্রোটি থেমে গেলে শিবির ক্যাডাররা ছাত্রলীগের মাইক্রোবাসের সামনে গিয়ে গুলি চালাতে থাকে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও মাইক্রোবাস চালক। এ সময় পাশের একটি অটোরিকশার চালকও গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তার ওপর লুটিয়ে পড়েন। একনাগারে গুলির বিকট শব্দে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন মাটিতে শুয়ে নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করে। কেউ কেউ পাশের একটি পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরাপদে চলে যান। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তা ফাঁকা। মাত্র পাঁচ মিনিটেই হত্যাকান্ড ঘটিয়ে অস্ত্রধারীরা আবারো নীল মাইক্রোবাসে চড়ে বসে। ওমর আলী মাতব্বর লেইন ধরে কক্সবাজার দিয়ে অস্ত্রধারীরা পালিয়ে যায়। ঘটনার ১৫ মিনিট পর পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। নিহতরা হলেন, কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট ছাত্র সংসদের সাবেক সহ সভাপতি হাসিবুর রহমান হেলাল, এজিএস রফিকুল ইসলাম সোহাগ, ইনস্টিটিউটের ছাত্র জাহাঙ্গীর হোসেন, বায়েজীদ বোস্তামী, ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সহ সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম, শের শাহ কলেজ ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক আবুল কাশেম, জাহিদ হোসেন এরশাদ, মাইক্রোবাস চালক মনু মিয়া এবং অটোরিকশা চালক কাশেম।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর