বৃহস্পতিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মানি লন্ডারিং তদন্তের ক্ষমতা চায় পিবিআই

আদালতে ফেরত শতাধিক মামলা

মাহবুব মমতাজী

অন্য আইনের করা মামলা তদন্ত করতে গিয়ে প্রায়ই মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ খুঁজে পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এমন মামলার সংখ্যা ১০০-এর বেশি। মানি লন্ডারিং আইনে তদন্তের ক্ষমতা না থাকায় ওইসব মামলার তদন্ত সম্পন্ন করতে পারছে না সংস্থাটি। এ অবস্থায় নিষ্পত্তি না করেই মামলাগুলো আদালতে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। সূত্র জানায়, মামলা নিষ্পত্তি করতে মানি লন্ডারিং আইনে তদন্তের ক্ষমতা চেয়ে গত ২৫ জুলাই পুলিশ সদর দফতরে চিঠি দিয়েছে পিবিআইর প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। গতকাল পর্যন্ত চিঠির বিষয়ে কোনো নির্দেশনা বা সিদ্ধান্ত পায়নি পিবিআই। চিঠিতে বলা হয়েছে, পিবিআই বিভিন্ন আইনের ১৫ ধরনের অপরাধ তদন্ত করে থাকে। এসব মামলা তদন্তে দেখা যায়- কিছু কিছু অপরাধ এমনভাবে সংঘটিত হয়েছে যা পিবিআই বিধিমালার তফসিলের অন্তর্ভুক্ত ও তফসিলের বাইরে।

যেগুলো আইনি জটিলতার কারণে পিবিআইর তদন্ত কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। পিবিআইর তফসিলভুক্ত অপরাধ তদন্তকালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে সম্পৃক্ত অপরাধের সংশ্লিষ্টতা অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়। মানি লন্ডারিং মামলা তদন্তের জন্য শুধু বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সেহেতু অন্য অপরাধ তদন্ত করতে গিয়ে মানি লন্ডারিং অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেলেও পিবিআইকে সংশ্লিষ্ট অপরাধ তদন্ত অনিষ্পন্ন রেখে বিজ্ঞ আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের তফসিলে বর্ণিত অপরাধ এবং পিবিআইর বিধিমালায় বর্ণিত অপরাধের সামঞ্জস্যতা রয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে তদন্তকারী সংস্থা হিসেবে পিবিআইকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে সংস্থাটি তদন্ত করতে পারবে এবং মানি লন্ডারিং আইন প্রণয়নের প্রকৃত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

জানতে চাইলে পিবিআইর প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, অর্থ আত্মসাৎ, অপহরণ, মানব পাচার, চোরাচালান, অস্ত্র এবং মাদকের মতো শতাধিক মামলা তদন্তে নেমে মানি লন্ডারিং আইনে সম্পৃক্ত অপরাধের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। যেহেতু পিবিআইর কাছে মানি লন্ডারিং আইনে সম্পৃক্ত অপরাধ তদন্তের ক্ষমতা নেই। তাই তারা তদন্ত সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না।

আইন সংক্রান্ত জটিলতার কারণে পিবিআই যেসব মামলা তদন্ত সম্পন্ন করতে পারেনি, এর মধ্যে রয়েছে ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবরের রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় করা একটি মামলা। মামলা নম্বর-৩২।

পিবিআই সূত্র জানায়, ওই মামলায় আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার আবু হানিফ অভিযোগ করেন, মেসার্স মেহেদী এক্সপোর্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিফাত শারমিন সেতু ঋণ খেলাপি। হেবা দলিলে পাওয়া সম্পত্তি সিফাত শারমিন সেতু আল আরাফাহ ব্যাংকে বন্ধক রেখে আড়াই কোটি টাকা ঋণ নেন। ২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ঋণের টাকা ভোগ করতে থাকেন। ওই ঋণ পরিশোধ না করায় ২০১৭ সালের ২০ জুন অর্থ ঋণ আদালত সেতু এবং তার বাবা মাহমুদ আলম আজাদ ও মা মিসেস ফেরদৌসী আজাদকে ৫ কোটি ৭৬ লাখ ৯৪ হাজার ৮৬৪ টাকা দিতে ডিক্রি জারি করে। ডিক্রির এই টাকা আদায়ে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক অর্থ জারি মামলা করে। এই মামলার পরপর আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড জানতে পারে যে বন্ধকীর সম্পত্তির হেবা দলিল, দলিল দাতারা বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে সেটি প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে ব্যাংকে বন্ধক রাখা সম্পত্তির মালিকানা ঋণগ্রহীতা সিফাত শারমিন সেতুর নামে আর থাকল না। এ ঘটনায় সেতু এবং তার বাবা-মা পরস্পর যোগসাজশে ব্যাংকের প্রায় ৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এক্ষেত্রে ব্যাংক যখন উক্ত সম্পত্তি বন্ধকী হিসেবে গ্রহণ করেছে তখন তা সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করেনি। অথবা ইচ্ছা করেই এড়িয়ে গেছে। ব্যাংকের তৎকালীন ম্যানেজারসহ কয়েক কর্মকর্তা এ ঘটনায় জড়িত। যা মানিলন্ডারিং আইন-২০১২ অনুযায়ী সুস্পষ্ট অপরাধ। ২০১৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মতিঝিল থানায় আরেকটি মামলা হয়। এ মামলার বাদী ইব্রাহিম হোসেন বয়োজ্যেষ্ঠ বাংলাদেশি ব্রিটিশ নাগরিক। দীর্ঘদিন ব্রিটেনে আছেন। পৈতৃক বাড়ি বিক্রির ২ কোটি ১০ লাখ টাকা শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় ৬টি এফডিআর করেন। মামলার আসামি কবির ওই ব্যাংকের ওয়ান স্টপ সার্ভিসের দায়িত্ব পালন করতেন। ইব্রাহিম হোসেন সরল বিশ্বাসে এফডিআরের স্বাক্ষরিত চেক বই কবিরের কাছে রাখেন। পরে কবির এগুলো ভাঙিয়ে তার নিজ অ্যাকাউন্ট, তার স্ত্রী, পিতামাতাসহ নিকটাত্মীয়দের নামে শেয়ার বাজারে লেনদেন করেন। ইব্রাহিমের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক কবিরকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়নি। পরে ইব্রাহিমের করা মামলা তদন্তে দেখা যায়, কবিরের শেয়ার বাজারে ২০ কোটি টাকার বেশি লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। তার স্ত্রী ও পিতা-মাতার নামে এসব লেনদেন হয়েছে। পারিবারিক অবস্থা তেমন সচ্ছল না, এরপরও ব্যাংকের চাকরিতে অল্পদিনে অর্থ আত্মসাৎ করে ২০ কোটি টাকার মতো শেয়ার কেনাবেচার মাধ্যমে বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। যা মানিলন্ডারিং আইনের অপরাধ। পিবিআই এই মামলায় প্রতারণা ও জালিয়াতির ধারায় প্রতিবেদন দিতে পেরেছে। এদিকে ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে কবির অর্থ ঋণ আদালতে চেক ডিজঅনার (৩ কোটি ও ৫ কোটি টাকার চেক) মামলা করে। এতে ইব্রাহিমকে গ্রেফতার হয়ে জেলহাজতে যেতে হয়। ইব্রাহিম এক মাস জেল খেটে ব্রিটেনে চলে যান। এদিকে ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর আদালতে সাবেক স্বামী মোরশেদের বিরুদ্ধে ৪০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেন রোখসানা গাফফার। মামলা তদন্তে দেখা যায়-  রোখসানা গাফফারের নামে ভুয়া হিসাব খুলে মোরশেদ ৪০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ মঞ্জুর করেন। পরে মোরশেদ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশে হিসাব থেকে সব টাকা তুলে নেন। অথচ রোখসানা ওই ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করা এবং তা থেকে টাকা উত্তোলনের বিষয়ে কিছুই জানতেন না। এই মামলায় মোরশেদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধির প্রতারণা ও জালিয়াতি ধারার অপরাধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। অথচ মানিলন্ডারিং আইনে সুস্পষ্ট অপরাধ করার পরও পিবিআই কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

সর্বশেষ খবর