বৃহস্পতিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনিদের কেউ আর বেঁচে নেই

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনিদের কেউ আর বেঁচে নেই

সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। অভিজাত এলাকার একটি মার্কেটে তখনো মানুষের ভিড়। পার্কিংয়ে গাড়ি ঢুকছে, বেরোচ্ছে। হঠাৎ ‘ডাকাত ডাকাত’ চিৎকারে মার্কেট প্রকম্পিত। দোতলার সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নেমে আসছিল অস্ত্রধারী কয়েক যুবক। তারা ফাঁকা গুলি করছিল। মার্কেটের সাহসী এক তরুণ ব্যবসায়ী অস্ত্রধারী এক সন্ত্রাসীকে জাপটে ধরে ফেলেন। তাকে ছাড়িয়ে নিতে তার সহযোগীরা ওই ব্যবসায়ীর বুকে গুলি চালায়। এতে তার বুক-পিঠ বুলেটে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায়।

২১ বছর আগে রাজধানীর বনানী কুয়েত মৈত্রী মার্কেটে তরুণ ব্যবসায়ী ইফতেখার আহমেদ শিপু খুনের ঘটনা এটি। আর এ হত্যার নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন শাসকদলের একজন প্রভাবশালী এমপির ছেলে জুয়েল। শিপুকে হত্যা করেই ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে তারা গাড়ি চড়ে লাপাত্তা হয়ে যান। অভিযোগ রয়েছে, খুনের পর জুয়েল ও তার বন্ধুরা গুলশান থানা পুলিশের পাহারায় ওই এলাকা ত্যাগ করেন। তখন এ ঘটনা সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে।

বিশেষ করে এমপির ছেলের জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর এটি হয়ে ওঠে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। খুনের প্রতিবাদে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন সংগঠন বিচারের দাবি জানিয়ে রাস্তায় নামে। ধর্মঘট, হরতাল সবই হয় এ খুনের প্রতিবাদে। চাঞ্চল্যকর শিপু হত্যা মামলার বিচারে আদালত জুয়েলসহ ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়। তবে প্রত্যেকেই এখন মুক্ত। এ পর্যন্ত দুজনকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পেরেছে। জুয়েলসহ চারজন কখনই এ মামলায় গ্রেফতার হননি। মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আসামি গ্রেফতারে কলকাতা পর্যন্ত হানা দেয়। কিন্তু পুলিশ পৌঁছার আগেই খুনিরা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলেন। এ ছাড়া এমপির বাসভবন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও পুলিশ হানা দেয় আসামি গ্রেফতারে। ২০০০ সালের ২৪ মে তৎকালীন প্রভাবশালী এমপির ছেলে জুয়েল ও তার সহযোগীরা কুয়েত মৈত্রী মার্কেটের তৃতীয় তলায় মোবাইল ডটকম নামে একটি দোকানে যান। দামি মোবাইল ফোন সেট ছিনিয়ে নিয়ে তারা দোকান থেকে বেরিয়ে যান। এ সময় ওই দোকানের মালিক ইফতেখার আহমেদ শিপু মার্কেটের নিচে রজনীগন্ধা নামে একটি দোকানে বসা ছিলেন। তিন তলায় তার দোকানের কর্মচারীর চিৎকার শুনে শিপু রজনীগন্ধা দোকান থেকে বেরিয়ে আসেন। তখন জুয়েলসহ ছয়জন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিলেন। শিপু জুয়েলকে জাপটে ধরে ফেলেন। সহযোগীরা জুয়েলকে ছাড়িয়ে নিতে ধস্তাধস্তি শুরু করেন। একপর্যায়ে জুয়েলের সহযোগী জোবায়ের শিপুর বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে পরপর দুই রাউন্ড গুলি চালান। গুলি শিপুর বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় সেখানেই লুটিয়ে পড়েন। ঘটনাস্থলেই শিপুর মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনায় শিপুর ভাই ইশতিয়াক আহমেদ বাদী হয়ে গুলশান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু জুয়েল ও তার সহযোগীদের পুলিশ আটক করেনি। পরে তারা প্রথমে ভারত এবং সেখান থেকে কেউ অস্ট্রেলিয়া, কেউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তবে আসামিদের কেউ এখন বেঁচে নেই। অকালেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। কেউ কারাগারে, কেউ দুর্ঘটনায়, আবার কেউ রোগে মারা গেছেন। শিপু হত্যার সময় তার একমাত্র মেয়ে জায়না চার বছরের ছিল আর ছেলে জারিফের বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর। খুনিরা গ্রেফতার না হওয়ায় আক্ষেপ ছিল শিপুর বাবা-মায়ের। ছেলের নৃশংস খুনের ঘটনার বিচার দেখে যেতে পারেননি তারা। ২০০৪ সালে শিপুর বাবা মকবুল আহমেদ ও ২০১০ সালে মা রাবেয়া খাতুন মারা যান। প্রকাশ্যে শিপুকে হত্যার ঘটনায় আদালত রায় দেয় আসামিদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড। কোনো আসামিও ধরা পড়েনি। আলোচিত শিপু হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ক্ষমতাসীন দলের এমপির ছেলে হওয়ায় পুলিশ কোনো আসামিকে গ্রেফতার করেনি বলে হতাশ তারা। মামলার তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক রেজাউল করিম। তিনি বলেন, তাদের কাছে খবর ছিল কলকাতার একটি হোটেলে শিপুর হত্যার আসামিরা আত্মগোপন করে আছেন। তারা কলকাতা গিয়ে ওই হোটেলে অভিযান চালান সেখানকার পুলিশের সহযোগিতায়। কিন্তু তাদের পাওয়া যায়নি। সেখানে পাওয়া গিয়েছিল দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনকে। ইমনকে গ্রেফতারের পর কলকাতা পুলিশে হস্তান্তর করা হয়। তিনি বলেন, এ মামলায় ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এরা হলেন জুয়েল, সাগর, সৈকত, জয়, জোবায়ের ও শফিউল। জয়কে রক্তমাখা কাপড়সহ গ্রেফতার করা হয়েছিল। সাগরও গ্রেফতার হন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর