শনিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

সংকটেও খাদ্য মজুদে রেকর্ড

মানিক মুনতাসির

সংকটেও খাদ্য মজুদে রেকর্ড

চলমান করোনাভাইরাস মহামারীর সংকট সত্ত্বেও ধান, চাল, মাছ, মাংস, সবজি, ফলমূলসহ বিভিন্ন রকম খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে খাদ্যপণ্যের আমদানি। তারপরও কমছে না চালের দাম। অন্যান্য খাদ্যপণ্যের বাজারও ঊর্ধ্বমুখী। বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনার সংকট কিছুটা কমে আসায় মানুষের হাতে আবারও অর্থের সরবরাহ বাড়তে শুরু করেছে। আবারও বাড়ছে উৎপাদন ও চাহিদা। তবে সরবরাহ চেইনের ত্রুটি ও দুর্বল বাজার মনিটরিংয়ের জন্য দাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এ ছাড়া ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় বেড়েছে আমদানি খরচও। এ জন্য খাদ্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরবরাহ চেইন ও তদারকি ব্যবস্থা আরও জোরদারের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মোট মজুদ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৪৫ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ১৫ লাখ ৯৬ হাজার ও গম ১ লাখ ৬২ হাজার টন। এ ছাড়া ধানের মজুদ দাঁড়িয়েছে ৮৭ হাজার টন। গত বছরের একই সময়ে খাদ্য মজুদ ছিল ১১ লাখ টন। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ৭ লাখ টন খাদ্য মজুদ বেড়েছে। বর্তমানে দেশে সিএসডি ও এলএসডি গোডাউনের বর্তমান ধারণ ক্ষমতা ২১ লাখ টন।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, যে কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকদের খাদ্য নিরাপত্তায় সরকারিভাবে কমপক্ষে ৬০ দিনের খাদ্য মজুদ রাখা প্রয়োজন। আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর এক দিনের খাদ্য চাহিদা প্রায় ৪৬ হাজার টন। সে হিসাবে ৬০ দিনের জন্য খাদ্য মজুদ রাখার কথা ২৭ লাখ টন। সেখানে সরকারের কাছে খাদ্য মজুদ রয়েছে ১৮ লাখ ১৪ হাজার টন। যা সাম্প্রতিক সময়ের রেকর্ড পরিমাণ          মজুদ। তবে বাংলাদেশের মানুষের ঘরে, মিল, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় খাদ্যপণ্য যথেষ্ট মজুদ রয়েছে বলে মনে করে সরকার। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন ব্যবস্থা নেই। যেটি বাংলাদেশের মানুষের ঘরে খাদ্য মজুদের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো- বাজারে ৫০ টাকা কেজির নিচে কোনো চাল পাওয়া যায় না। গরিবের মোটা চালও এখন ৫০-৫২ টাকায় কিনতে হয়। আর মাঝারি মানের চিকন চালের (নাজিরশাইল) প্রতি কেজি গতকালও বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকায়। এ ছাড়া তেল, চিনি, আটা, আদা, রসুন মাছ-মাংস সবকিছুর দামই চড়া। বিশেষ করে সয়াবিন তেলের দাম তো রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে ১৫০ টাকা লিটারে ঠেকেছে। আর চিনির কেজি ৮০ টাকা অতিক্রম করায় সরকার বৃহস্পতিবার দাম বেঁধে দিতে বাধ্য হয়েছে। গত প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে পিঁয়াজের কেজি ৫০ টাকার নিচে নামছে না। আদা-রসুনের বাজারও ঊর্ধ্বমুখী। এ ছাড়া মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বিশ্ব রেকর্ড করলেও মাছের দাম বেড়েছে। চাষ করা রুই মাছও প্রতি কেজিতে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে বছরের ব্যবধানে। গরুর মাংসের কেজি তো ৬০০ টাকা অতিক্রম করেছে। গ্রামের মানুষ এক মণ ধান বেচেও এক কেজি গরুর মাংস কিনতে পারেন না এমন নজির স্থাপন হয়েছে।

এদিকে সংকট এড়াতে খাদ্যশস্য আমদানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ খাদ্য সংগ্রহের সাফল্য দেখিয়েছে সরকার। চলতি বোরো সংগ্রহ মৌসুম কার্যক্রম সফলভাবে সমাপ্ত হয়েছে। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৩ লাখ ৬২ হাজার ৪৪৫ টন বোরো ধান, ১০ লাখ ৬০ হাজার ৪৬০ টন সিদ্ধ বোরো চাল, ৮৫ হাজার ৫০৩ টন বোরো আতপ চাল সংগ্রহ হয়েছে। এ ছাড়া ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ১ লাখ ৩ হাজার ২১২ টন গম সংগ্রহ হয়েছে। এ ছাড়া গত অর্থবছরের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রায় ৭ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করা হয়েছে। সূত্র জানায়, গত বছরের মার্চে বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়। তখন দেশে সরকারিভাবে খাদ্য মজুদ ছিল প্রায় ১৬ লাখ টন। চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সরকারি ব্যবস্থাপনায় খাদ্য মজুদের পরিমাণ নামে ৫ লাখ টনের নিচে। ফলে তখন খাদ্য মজুদ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন বিশেষজ্ঞরা। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটি কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের বরাত দিতে বলা হয়, উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। ঠিকই পাঁচ মাস পর এখন খাদ্যশস্য মজুদের রেকর্ড গড়েছে সরকার। এদিকে দেশে প্রতি মাসে খাদ্যের চাহিদার গড় ১৯ থেকে ২১ লাখ টন। যার প্রায় ৮০ ভাগই অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে মেটানো হয়। খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে প্রতি বছর ৭০ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। এ বছর প্রায় ১৫ লাখ টন গম অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত হয়েছে। এ ছাড়া সমানতালে গম এবং চাল আমদানিও করা হচ্ছে। বুধবারও আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রোটিন মাত্রার ৫০ হাজার টন গম আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন করেছে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এতে ব্যয় হবে ১৭৯ কোটি টাকা।

এর বাইরে খাদ্যপণ্য হিসেবে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, শাক-সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। দেশে উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের সদ্ব্যবহার করতে পারলে আগামী এক বছরে খাদ্য ঘাটতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে বৈশি^ক কৃষি ও সামগ্রিক উৎপাদন খাতে এর প্রভাব পড়বে আশঙ্কা করা হয়েছিল। আশার খবর হচ্ছে, বাংলাদেশে সেটি হয়নি। তবে দেশের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হয়নি। ফলে অনেক শাক-সবজি নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া পথে পথে চাঁদাবাজি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য রয়েই গেছে। যার ফলে অনেক হাত বদল হয়ে খাদ্যপণ্য ভোক্তা পর্যায়ে আসা পর্যন্ত দাম বেড়ে যায় কয়েকগুণ। পাশাপাশি মনিটরিং ব্যবস্থাও ঢিলেঢালা হওয়ায় কারসাজিকারীরাও সক্রিয় থাকে প্রায় সারা বছরই। যার ফলে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম অনেক বেশি পড়ে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আমদানি খরচ বাড়ার সঙ্গে প্রবাসী আয় প্রবাহ কমায় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেল ও খোলা বাজারে টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের মূল্য বেড়েই চলেছে। যে কারণে চাপের শিকার হচ্ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় বাজার। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে টাকার বিপরীতে নগদ ডলারের দাম বেড়েছে। গত এক সপ্তাহে ৩০ পয়সা থেকে ৪০ পয়সা বেড়ে, এখন প্রায় ৮৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহের দিনগুলোতে এলসির (লেটার অব ক্রেডিট) দর ৩০ পয়সা বেড়ে ৮৫ দশমিক ২৫ টাকায় পৌঁছেছে। ফলে আমদানি খরচ বেড়েছে। যা আমদানি করা খাদ্যপণ্যের ওপর এক ধরনের প্রভাব ফেলছে। এতে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের অঙ্গীকার হলো ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। এর অংশ হিসেবে একজন মানুষও যেন খাবারে কষ্ট না পায় সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পায় সেটা নিশ্চিত করতে খাদ্য মন্ত্রণালয় সর্র্বাত্মকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। খাদ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক সারোয়ার মাহমুদ বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে সারা বিশ্বেই স্থবিরতা নেমে এসেছিল। সব ধরনের উৎপাদন কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়েছিল। জাতিসংঘ খাদ্য সংকটের ব্যাপারে সতর্ক করেছিল। আমরা বিভিন্ন রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছিলাম বলেই আজকে খাদ্য মজুদে রেকর্ড হয়েছে। আমাদের এখানে খাদ্যপণ্যের কোনো রকম সংকট হয়নি।

সর্বশেষ খবর