শনিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

নুসরাতের অপকর্মের ঢাল স্বামীর রাজনৈতিক পরিচয়

আলাউদ্দিন আরিফ কুমিল্লা থেকে ফিরে

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার পদুয়ারবাজার বিশ্বরোড সংলগ্ন একটি গ্রাম দৈয়ারা। এই গ্রামে বিগত এক শ বছরের মধ্যে কোনো তাঁতী সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করত- এমন তথ্য কারও জানা নেই। কিন্তু হঠাৎ করেই গত ৩ জুন বাংলাদেশ তাঁতী লীগ কুমিল্লা মহানগর শাখার আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এই কমিটির আহ্বায়ক ও যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয় স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মফিজুর রহমানের দুই ছেলে মো. মিজানুর রহমান ও মো. জিয়াউর রহমানকে। এ কমিটি দেখে খোদ কুমিল্লার প্রবীণ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারাও বিস্মিত ও হতবাক। তারা তাঁতী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। তাদের প্রশ্ন, ছাত্রদলকর্মী মিজান কী করে তাঁতী লীগের আহ্বায়ক হয়?

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য ও কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং কুমিল্লার প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ কমিটি আমার কনসেন্টে হয়নি। আমি এ কমিটির বিষয়ে কিছুই জানি না। এ বিষয়ে ঢাকায় তাঁতী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন।’  তাঁতী না হয়েও ব্যাংকারসহ অন্যান্য পেশার লোক দিয়ে কুমিল্লা মহানগর তাঁতী লীগের ৩১ সদস্যের কমিটি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁতী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মো. শওকত আলী বলেন, ‘কিছু দিন আগে আমরা কুমিল্লা মহানগর তাঁতী লীগের কমিটি দিয়েছি। সেখানে কারা কারা স্থান পেয়েছে লিস্ট না দেখে এ মুহূর্তে আমি বলতে পারব না। কমিটিতে বিতর্কিত কেউ স্থান পেয়ে থাকলে তাদের বাদ দিয়ে নতুন কমিটি দেওয়া হবে।’

দৈয়ারা গ্রামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একজন নেতা আলাপকালে বলেন, ‘এক সময় ছাত্রদল করা মিজানুর রহমান সানি হঠাৎ করে হাইব্রিড আওয়ামী লীগ হয়ে যায়। সে স্ত্রী নুসরাত জাহান তানিয়ার নানামুখী অপতৎপরতায় জেলা কৃষক লীগের কমিটির সদস্য পদে স্থান পায়। এরপর নুসরাতের চেষ্টায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কিছু ব্যক্তিকে অবৈধ পন্থায় ‘ম্যানেজ’ করে স্বামী মিজানুর রহমান ও দেবর জিয়াউর রহমানকে আহ্বায়ক ও যুগ্ম আহ্বায়ক করে মহানগর তাঁতী লীগের কমিটি নিয়ে আসে। অথচ আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা বছরের পর বছর ঘুরেও একটি কমিটিতে স্থান পায় না। এমনকি এমপি বাহার সাহেব চেষ্টা করেও কেন্দ্র  থেকে কমিটি আনতে পারেন না।’

স্থানীয় আওয়ামী লীগের অপর এক নেতা বলেন, নুসরাত ও মিজান রাজনৈতিক সিঁড়ি পেতে ও অবৈধ অর্থ আয়ের পথ সুগম করতে ছোট বোন মোসারাত জাহান মুনিয়াকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত। তারা বিভিন্নজনের কাছে মুনিয়াকে পাঠিয়ে তদবির ও নানা পদ বাগিয়ে নিত। মুনিয়া ছাড়াও নুসরাত কিছু উঠতি বয়সের তরুণী গ্যাং সদস্যদের তার কাজ বাগিয়ে নেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। আর তার এসব অপকর্মের ঢাল হিসেবে স্বামী মিজানুর রহমানের পদ-পদবিকে ব্যবহার করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জানান, বাংলাদেশ তাঁতী লীগের ঘোষিত লক্ষ্য দেশের তাঁতী সমাজের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ওই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত তাঁতীদের নিয়ে কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়নি। অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে নানা ধরনের অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে সংগঠনটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। তাঁতী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি শওকত আলী ও সাধারণ সম্পাদক খগেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথকে ম্যানেজ করে তারা বিতর্কিত এ কমিটি নিয়ে আসে। দৈয়ারা গ্রামের স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কয়েক নেতা জানান, আহ্বায়ক মিজানুর রহমান ছাড়াও তাঁতী লীগের আহ্বায়ক কমিটিতে যুগ্ম আহ্বায়ক পদে স্থান পেয়েছেন তার আপন ছোট ভাই জিয়াউর রহমান ও তার ভাগ্নে মঞ্জুরুল আহসান শাকিল এবং সদস্যপদে স্থান লাভ করেছেন তার ফুফাতো ভাই আবু ইমরান কাউসার শুভ। এভাবে ৩১ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে তার পরিবারের সদস্য ও বন্ধুবান্ধব দিয়ে। কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড়  মোড়ে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয় রয়েছে। সেখানে তাঁতী লীগের বিতর্কিত এ কমিটির কেউ যায় না। কুমিল্লা মহানগর ছাত্রদলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা জানান, ‘ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পড়ার সময় মিজানুর রহমান সানি ও তার ভাই জিয়াউর রহমান ছাত্রদল করত। ছাত্রদলের তেমন কোনো পদে না থাকলেও নিয়মিত মিছিলে অংশ নিত। তার অপর ভাই রাসেল ছাত্রশিবিরের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত ছিল। সে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এলাকায় একটি স্কুলও করেছে। সেই স্কুল নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক।’  জানা গেছে, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সংগঠনটির মূল লক্ষ্য তিনটি : তাঁতী সমাজসহ পশ্চাৎপদ শ্রেণি-পেশার মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, তাঁতশিল্প ও বস্ত্র খাতের সংকট চিহ্নিত করে বাস্তবমুখী সমাধানের কর্মসূচি নেওয়া ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে দলের সব কর্মসূচি, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করা। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে পাকিস্তান তাঁতী সমিতি নামে ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এ সংগঠন। স্বাধীনতার পর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ তাঁতী সমিতি। ২০০৪ সালে তাঁতী লীগ নাম নিয়ে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে যাত্রা শুরু করে। এর প্রথম পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয় ২০১৭ সালে। ২০১৯ সালে ওই কমিটির মেয়াদ শেষ হয়। নিয়ম অনুযায়ী এখানে তাঁতীদের স্থান পাওয়ার কথা। জেলা ও মহানগর পর্যায়ের কমিটিগুলোতে নানা বিতর্কিত ব্যক্তিদের দিয়ে আহ্বায়ক ও জেলা কমিটি করার অভিযোগ রয়েছে এ সংগঠনের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে।

সর্বশেষ খবর