সোমবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

দেশের চার এয়ারলাইনসের দেনা ৫ হাজার কোটি টাকা

বেবিচকের সারচার্জ কমানোর আবেদন এভিয়েশন অ্যাসোসিয়েশনের

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

এয়ারপোর্টসংশ্লিষ্ট সেবার বিপরীতে দেশের চার এয়ারলাইনসের কাছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)-এর পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। এর বেশির ভাগই বাংলাদেশ বিমানের দেনা। রাষ্ট্রীয় এই উড়ান প্রতিষ্ঠানের কাছে বেবিচকের পাওনা ৪ হাজার কোটি টাকার মতো। বাকি এয়ারলাইনসের মধ্যে জিএমজি, ইউনাইটেড ও রিজেন্ট এয়ারের দেনার পরিমাণ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উড়ানসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সেবা নিয়ে সময়মতো মাশুল পরিশোধ না করায় এয়ারলাইনসগুলোর এই দায় সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে রিজেন্ট এয়ার দেনা পরিশোধ না করায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করেছে বেবিচক।

অবশ্য এয়ারলাইনসগুলোর মালিকপক্ষ এভিয়েশন অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এওএবি) বলছে, তাদের কাছে বেবিচকের প্রকৃত পাওনার পরিমাণ উল্লিখিত অর্থের মাত্র এক চতুর্থাংশ। বাকি এক তৃতীয়াংশ মূল পাওনার ওপর আরোপিত সারচার্জ। এ কারণে বেবিচকের আরোপিত সারচার্জ কমানোর জন্য অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে তারা আবেদন করেছেন। গতকাল এই আবেদনটি অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পৌঁছানো হয়। সূত্র জানায়, এয়ারপোর্ট রক্ষণাবেক্ষণসহ বিমানের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে সেবা দেওয়ার বিপরীতে এয়ারলাইনসগুলো প্যাসেঞ্জার প্রতি একটি মাশুল বা ফি পরিশোধ করে বেবিচক-কে। অভ্যন্তরীণ রুটে প্যাসেঞ্জার প্রতি ৭৩৮ টাকা এবং আন্তর্জাতিক রুটে দেশভেদে এই মাশুলের পরিমাণ ৩ থেকে ৬ হাজার টাকা আরোপ করা হয়। এর মধ্যে ল্যান্ডিং চার্জ, পার্কিং চার্জ, নেভিগেশন ফি, নিরাপত্তা ফি, এম্বারগেশন ফিসহ নানা ধরনের ফি থাকে। প্রতি ১৫ দিন পরপর এয়ারলাইনসগুলোকে বেবিচকের এই ফি পরিশোধ করতে হয়। এ সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে না পারলে মূল বকেয়ার ওপর প্রতি মাসে ৬ শতাংশ হিসেবে অতিরিক্ত চার্জ বা সার্ভিস চার্জ আরোপ করতে থাকে বেবিচক। যেমন, কোনো এয়ারলাইনসের কাছে বেবিচকের পাওনা মাশুলের পরিমাণ ১ কোটি টাকা, এটি ১৫ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে না পারলে পরের প্রতি মাসে ৬ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ আরোপ করবে বেবিচক। এতে ১ কোটি টাকার ওপর প্রতি মাসে ৬ লাখ টাকা করে অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ যোগ হবে মূল বকেয়ার সঙ্গে। দেখা যাচ্ছে, কোনো এয়ারলাইনস এক বছর ১ কোটি টাকার মাশুল পরিশোধ না করলে এর ওপর বেবিচকের সার্ভিস চার্জ আরোপ হয় ৭২ লাখ টাকা।

এওএবি’র সেক্রেটারি জেনারেল মফিজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে এয়ারলাইনসের ওপর যে ধরনের সার্ভিস চার্জ আরোপিত এটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। কোনো এয়ারলাইনস বিল পরিশোধ করতে না পারলে বকেয়ার ওপর সারচার্জ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে, তবে সেই হার যৌক্তিক ও পরিশোধযোগ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ পরিস্থিতিতে দেশের ব্যাংকরেটের সঙ্গে সমন্বয় রেখে আরোপিত সারচার্জ কমিয়ে আনার বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে তারা আবেদন করেছেন বলে জানান অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল। গতকাল অর্থ বিভাগে পাঠানো এওওবি’র আবেদনে বলা হয়েছে, চলমান কভিড মহামারীতে অন্যান্য দেশের মতো এভিয়েশন ব্যবসা সংকটে পড়েছে। এয়ারলাইনসগুলো তাদের পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না বলে সারচার্জ বেড়ে যাচ্ছে। সময়মতো পাওনা পরিশোধ না করার কারণে অনেক দেশেই সারচার্জ আরোপের নিয়ম আছে। তবে সেই সারচার্জের তুলনায় বেবিচকের আরোপিত হার অনেক বেশি। জুনভিত্তিক হিসাব দিয়ে আবেদনে ৪ এয়ারলাইনসের কাছে সারচার্জসহ বেবিচকের মোট পাওনার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে ৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ বিমানের কাছে পাওনা ৪ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা, এ ছাড়া জিএমজি এয়ারলাইনসের ৩৬৮ কোটি টাকা, ইউনাইটেড এয়াওয়েজের ৩৫৫ কোটি টাকা এবং রিজেন্ট এয়ারের ২৮৩ কোটি টাকা। এওওবি বলেছে, তাদের এই দেনার বেশির ভাগই সারচার্জ আরোপের কারণে হয়েছে।

এশিয়ার চারটি দেশের সারচার্জ আরোপের তথ্য দিয়ে এওএবি বলছে, এয়ারলাইনসের বকেয়ার ওপর বার্ষিক সারচার্জ হিসেবে ভারতে ১২ থেকে ১৮ শতাংশ, সিঙ্গাপুর ৮ শতাংশ, মালয়েশিয়া ১২ শতাংশ, ওমানে ১০ শতাংশ এবং পাকিস্তানে মাত্র ২ শতাংশ আরোপ করা হলেও বেবিচকের বার্ষিক সারচার্জ ৭২ শতাংশ। এওওবি’র আবেদনে বেবিচকের সার্ভিসচার্জসহ পাওনার জুনভিত্তিক একটি হিসাব দেওয়া হয়েছে যেখানে ৩টি এয়ারলাইনসের কাছে মোট পাওনার পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকা প্রায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেবিচকের মেম্বার (ফিন্যান্স) শফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আবেদনে পাওনার যে পরিমাণ দেখানো হয়েছে প্রকৃত পাওনা তার চেয়ে কম হবে। তিনি বলেন, বিমান চলাচলের আন্তর্জাতিক রীতি অনুসরণ করেই এয়ারলাইনসের মাশুলের ওপর সার্ভিস চার্জ আরোপ করা হয়। এ ছাড়া আরোপিত সার্ভিস চার্জ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের আইনি বিধি অনুসারেই নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে এটি কমানোর ক্ষমতা এই কর্তৃপক্ষের নাই।

বেবিচকের এই কর্মকর্তা বলেন, সরকারের পক্ষে অর্থ বিভাগ যদি মনে করে, সেক্ষেত্রে তারা এই সার্ভিস চার্জ কমাতে পারে। তবে এক্ষেত্রে এটিও মনে রাখতে হবে, এয়ারলাইনসগুলোকে দেওয়া সেবার বিপরীতে এই আয় দিয়েই বেবিচকের সমস্ত কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

সর্বশেষ খবর