বৃহস্পতিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

একটি অটো নিয়ে গেল খুনির কাছে

মির্জা মেহেদী তমাল

একটি অটো নিয়ে গেল খুনির কাছে

বাবার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে নিখোঁজ হন চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা রিজিয়া আক্তার রূপা। বিকালে যখন বাসা থেকে বেরিয়ে যান রূপা, তখন বলে গিয়েছিলেন সামনেই চাচার বাড়িতে যাচ্ছেন। সন্ধ্যার মধ্যেই বাসায় ফিরবেন। কিন্তু সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যাচ্ছে। বাসায় ফিরছেন না রূপা। কী ব্যাপার, সন্ধ্যা সেই কখন হয়েছে, রূপা তো ফিরছেন না বাসায়! ওই বাসায় একটা ফোন দাও তো রূপার মা। রূপার বাবা চিন্তিত হয়েই বললেন কথাটা। রূপার মা ফোন দেন রূপার ফোনে। কিন্তু ফোন বন্ধ। এরপর ফোন করেন রূপার চাচির ফোনে। কিন্তু রূপার চাচি যা বললেন, তাতে করে রূপার মায়ের বুক কেঁপে ওঠে। রূপার চাচি বললেন, বুবু কী বলেন? রূপা তো আসেনি আমাদের এখানে? এ কথা শুনেই রূপার মা তার স্বামীর দিকে তাকান। বলেন, ওগো শুনছ, রূপা নাকি যায়নি ওদের বাড়িতে। খাটের ওপর বসা ছিলেন রূপার বাবা। কথাটা শুনেই তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। বললেন, কী বলছ তুমি এসব। ওই বাসাতেই তো যাবে বলে গেল। সেই বিকালবেলা বের হলো, এখন তো রাত ৮টা বাজতে চলল। আমাদের মেয়ে কোথায় গেল তবে। অজানা আশঙ্কা তখন পুরো পরিবারে। তারা রূপার স্বামী হায়দার আলীকে ফোনে জানান। হায়দার আলী শুনে বলেন, বাবা, কী বলছেন এসব। আমার স্ত্রী কোথায়? আমি আসছি বাবা! রূপার বাবা ফোন কেটেই বেরিয়ে যান অন্তঃসত্ত্বা আদরের মেয়ের খোঁজ করতে। ঘটনাটি বান্দরবানের। গত ৭ আগস্ট বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেও রূপা আর ফিরে আসেননি। পাওয়া যায়নি জীবন্ত রূপাকে। তার লাশ পাওয়া যায় বান্দরবান রাঙামাটি সড়কের গলাচিপা মুসলিমপাড়ার ঝোপঝাড়ের মধ্যে। রাতেই গলা কাটা নারীর লাশ দেখে লোকজন পুলিশে খবর দেন। পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে। লাশটি ছিল রূপার। তার পরিবার শনাক্ত করে লাশটি। তার আগে রূপার স্বামী হায়দার আলী, বাবা ও পরিবারের অন্যদের সবাই গোটা এলাকা চষে বেড়ালেও খুঁজে পাননি তারা রূপাকে। নৃশংস খুনের শিকার রূপার লাশ উদ্ধারের পর স্বামী হায়দার আলী ভেঙে পড়েন। লাশ ধরে তিনি আহাজারি করেন। তার এমন কান্নায় স্থানীয় লোকজন চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। হায়দার আলী বলছিলেন, রূপা তুমি চলে গেলে আমায় একা রেখে। আমি বাঁচব কীভাবে?

রিজিয়া আক্তার রূপার বিয়ে হয়েছিল মাত্র আট মাস আগে। রাঙ্গুুনিয়া উপজেলাধীন বড়খোলাপাড়া খন্থাকাটা গ্রামের মৃত আবদুল লতিফের ছেলে হায়দার আলীর সঙ্গে বিয়ে হয় রূপার। রূপা চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। রূপাদের বাড়ি রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলার ধলিয়া মুসলিমপাড়ায়। তার বাবার নাম নুরুল ইসলাম। গত ১ আগস্ট রূপা তার শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি বেড়াতে যান। সাত দিন পরই মেলে লাশ। স্ত্রীকে খুনের খবর জেনে কখনো চিৎকার করে, কখনো নীরবে কাঁদেন হায়দার আলী। আর বলতে থাকেন, কাজল তুই এতো বড় ক্ষতি কেন করলি? আমার স্ত্রীকে কেন খুন করলি। চোখভরা জল নিয়ে স্ত্রীর দাফন-কাফন শেষ করেন হায়দার আলী। একই এলাকার কাজল নামের এক যুবক তার স্ত্রী খুনের ঘটনায় জড়িত বলে অভিযোগ করেন হায়দার।

স্বামী হায়দার আলী বান্দরবান থানায় স্ত্রী হত্যায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় তিনি আসামি করেন রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলার বাঙালহালিয়া ইউনিয়নের ডাকবাংলা বৌদ্ধ বিহারপাড়ার রকির প্রকাশ (রক্যার) ছেলে মোহাম্মদ কাজল হোসেনকে। হায়দার আলীর অভিযোগ, বিয়ের আগে কাজলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিয়ে করার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে তার স্ত্রী রূপাকে খুন করেছে কাজল।

পুলিশ তদন্ত শুরু করে। অভিযুক্ত কাজলকে গ্রেফতারে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েও তাকে গ্রেফতার করতে পারে না। এদিকে স্ত্রীর খুনি গ্রেফতার না হওয়ায় পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ হন হায়দার আলী। থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে বসে থাকেন। ধরনা দিতে থাকেন কাজলকে গ্রেফতারের জন্য। পুলিশ কাজলকে খুঁজে পায় না।

একদিকে স্ত্রী হারানোর শোক অপরদিকে কাজল গ্রেফতার না হওয়ায় হায়দার আলী যেন পাগলপ্রায়। পুলিশ বাদেও বিভিন্ন স্থানে গিয়ে তার স্ত্রীর খুনিকে গ্রেফতারের দাবি জানাতে থাকেন। বান্দরবান বাঙালহালিয়া বাজারে হায়দার আলী কাঁদতে কাঁদতে গণমাধ্যমকর্মী ও স্থানীয় লোকজনকে বলতে থাকেন, ‘আমার স্ত্রী রূপা তিন-চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। আমি মামলা করেছিলাম কাজল নামক ছেলেটির নামে, কিন্তু মামলার দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও ঘাতক কাজলকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তাকে আইনের আওতায় এনে দ্রুত গ্রেফতার করা হোক। আমাদের পরিবার বা দেশবাসী তার ফাঁসি চায়।’ এসব বলার সময় তিনি স্ত্রীর জন্য হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। সবাই তাকে সান্ত্বনা দেন। এলাকার লোকজনও কাজলকে গ্রেফতারের দাবি জানাতে থাকেন। পুলিশ রূপা হত্যা মামলাটি নিজেদের মতো করে তদন্ত চালাতে থাকে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে তদন্ত কাজ এগিয়ে নিতে থাকে। তদন্তকারী কর্মকর্তা বান্দরবান সদর থানার এসআই গোবিন্দ এ হত্যাকাে র রহস্য বের করতে বদ্ধপরিকর। তার চোখে রূপার স্বামীর শোক একটু ভিন্ন ধরনের লাগতে থাকে। তিনি খুব তীক্ষèভাবে খেয়াল করে দেখেন, হায়দার আলীর শোকের মধ্যে কোথাও ভিন্ন ধরনের ছাপ রয়েছে। এ বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে তদন্ত কর্মকর্তাকে। ইতিমধ্যে তার কাছে খবর আসে, ঘটনাস্থল পাহারের নিচে সড়কের সমানে একটি সিএনজি চালিত অটো দেখা গিয়েছিল সেই রাতে। পুলিশ খোঁজখবর নিতে শুরু করে সিএনজির। হয়তো খুনের ভিন্ন কোনো তথ্যও পাওয়া যেতে পারে। পুলিশ খোঁজখবর নিয়ে পেয়ে যায় সিএনজির নম্বর। নম্বরের সূত্র ধরে পুলিশ পৌঁছে যায় সিএনজির মালিকের বাসায়। পুলিশ মালিকের কাছে চালকের তথ্য চায়। মালিক তখন জানান, ৭ আগস্ট এ সিএনজির চালক ছিলেন মান্নান। যিনি এখন আর সিএনজি চালান না। তবে তার ঠিকানা আছে। পুলিশ ছুটে চলে মান্নানের বাসায়। মান্নানকে পায় না পুলিশ। পেয়ে যায় মান্নানের মাকে। মান্নানের মা পুলিশকে জানান, সিএনজিটি সেদিন মান্নানের কাছ থেকে হায়দার আলী নিয়ে গিয়েছিল। আর হায়দারের মোটরসাইকেল রেখে যায় মান্নানের কাছে। কী একটা কাজের কথা বলে হায়দার আলী সিএনজিটি নিয়ে গেছে। তা কাউকে বলতে বারণ করেছে। তদন্ত কর্মকর্তা নিজেই বিরবির করে বলতে থাকেন, তদন্ত ঠিক দিকেই এগোচ্ছে। এরপর পুলিশ পেয়ে যায় মান্নানকে। মান্নান জানান, হায়দার আলীর বাসা তাদের একই এলাকায়। অনেক পুরনো বন্ধুত্ব। হায়দার আলী বিদেশ ছিলেন। তার আগে এখানে সিএনজি চালাতেন। মান্নান বলেন, সেদিন হায়দার আলী এসে জানায়, আমার মোটরসাইকেলটি তুই চালাতে থাক। আমার একটা কাজ আছে। তেরি সিএনজি আমার লাগবে। একথা শুনে আমি তাকে সিএনজির চাবিটা দেই। হায়দার সিএনজি নিয়ে চলে যায়। পরে রাতে দিয়ে যায়। কী করেছে তা আমি জানি না।

পুলিশ অনেকটাই নিশ্চিত যে, খুনে কাজল নয়, স্ত্রী খুনে জড়িত স্বামী হায়দার আলী। পুলিশ এবার হায়দারকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নেয়। ঘটনার ২৮ দিনের মাথায় পুলিশ হায়দারের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে। থানায় নিয়ে চলে জেরা। কিন্তু সেসব অস্বীকার করতে থাকেন। এরপর তার বন্ধু সিএনজিচালক মান্নানকে মুখোমুখি করা হয়। তখন হায়দার আলী আর জবান বন্ধ রাখতে পারেন না। বলে দেন সব মুখস্থ নামতার মতো।

হায়দার আলী জানান, কাজলের সঙ্গে তার স্ত্রীর আগে সম্পর্ক ছিল। এই সম্পর্ক বিয়ের পরও টিকে ছিল। তিনি নিজেই দেখেছেন তাদের কথা বলতে। শুধু কথা বলতে দেখেই এমন খুনের সিদ্ধান্ত কেন নিলা- এমন প্রশ্নের জবাবে কোনো উত্তর দিতে পারেননি হায়দার।  যোগাযোগ করা হলে পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা এসআই গোবিন্দ বলেন, হায়দার আলী তার স্ত্রীকে সন্দেহ করতেন। সন্দেহের বশে খুনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি স্বীকার করে বলেছেন, ঘটনাটি তিনি একাই ঘটিয়েছেন। রূপাকে হত্যার পর ফেলে দেন পাহাড়ের পাশে ঝোপের মধ্যে। রূপার গলায় ছুরি চালালে রক্ত তার শার্টেও লাগে। পরে তার নিজের কাপড় খুলে তাতে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন। লাশ উদ্ধারের পরই তিনি বলে বেড়াতে থাকেন, কাজল খুন করেছেন তার স্ত্রীকে।

পুলিশ কর্মকতা গোবিন্দ আরও জানান, ঘটনার পর রূপার স্বামী হায়দার আলীর অতিমাত্রায় শোক ভাবিয়ে তোলে। একপর্যায়ে তার ওপর নজরদারি শুরু করি। সোর্স নিয়োগ করি। এরপরই তদন্তে বেরিয়ে আসে ভিন্ন ধরনের তথ্য। হায়দার আলী আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর