বৃহস্পতিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ট্যানারি পল্লীর সমস্যা ১৯ বছরেও সমাধান হয়নি

♦ প্রকল্পের মেয়াদ শেষেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমস্যা রয়েই গেছে ♦ সমস্যা সমাধানে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনা চান ব্যবসায়ীরা

রুহুল আমিন রাসেল

সাভারের হেমায়েতপুরে ১৯ বছর সময় নিয়ে ট্যানারি শিল্পনগরী নির্মাণ করা হলেও আদৌ সমস্যার সমাধান হয়নি। গত জুনে শিল্পনগরী প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বা সিইটিপি এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমস্যার কোনো সুরাহা হয়নি। ফলে ট্যানারি শিল্পনগরীকে অসম্পন্ন বলছেন ব্যবসায়ীরা।

এমন পরিস্থিতিতে ট্যানারি শিল্পনগরী বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করেছে পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এর পর থেকে ট্যানারি কারখানাগুলো পরিবেশ ছাড়পত্র পাচ্ছে না। এখন সমস্যা সমাধানে শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমদু হুমায়ুনকে ১৮ সেপ্টেম্বর দেওয়া পত্রে দিকনির্দেশনা চেয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) ও বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ)। এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন স্বাক্ষরিত পত্রে বলা হয়, ট্যানারি কারখানাসমূহ হাজারীবাগ থেকে নির্মাণাধীন অসম্পন্ন চামড়াশিল্প নগরীতে স্থানান্তর করা হলেও কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বা সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (সিইটিপি) এবং অন্যান্য উপাদানের কাজ এখনো শেষ হয়নি। এ অবস্থায় কয়েকটি ট্যানারির অনুকূলে পরিবেশ ছাড়পত্র প্রদান করা হলেও এখন পরিবেশ ছাড়পত্র নবায়নে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। আর পরিবেশগত ছাড়পত্র নবায়ন প্রাপ্তি বিলম্বিত হওয়ায় রপ্তানিকারক হিসেবে এক্সপোর্ট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট বা ইআরসি, আমদানিকারক হিসেবে ইমপোর্ট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট বা আইআরসি ও শুল্কমুক্তভাবে পণ্য আমদানির বন্ড সুবিধার ছাড়পত্র পেতে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া চামড়াশিল্প নগরীতে ডাম্পিং ইয়ার্ড তৈরি করা হলেও কঠিন বর্জ্য বা সলিড ওয়েস্ট ব্যবস্থাপনার নিয়মিত ব্যবস্থা রাখা হয়নি। পত্রে এফবিসিসিআই আরও বলেছে, ‘শিল্পনগরীর প্রকল্প মেয়াদ গত জুনে সমাপ্ত হলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো সমাধান হয়নি। শিল্পনগরীর চামড়া কারখানাসমূহের সুষ্ঠু উৎপাদন কার্যক্রমের স্বার্থে পরিবেশগত ছাড়পত্রের নবায়ন ত্বরান্বিতকরণ, সিইটিপি কার্যকর করা, আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ করার পাশাপাশি কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নিয়মিত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আপনার (শিল্পমন্ত্রী) দিকনির্দেশনা প্রয়োজন।’  এ সম্পর্কে ৩১ আগস্ট বিটিএ সভাপতি মো. শাহীন আহমেদ স্বাক্ষরিত পত্রে বলা হয়, পরিবেশবান্ধব চামড়াশিল্প নগরীর মুখ্য বিষয় হলো কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বা সিইটিপি এবং কঠিন বর্জ্য বা সলিড ওয়েস্ট ব্যবস্থাপনা। কিন্তু শিল্পনগরীর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কোনো সুরাহা হয়নি। ইতিমধ্যে সিইটিপি ও অন্যান্য উপাদানের মেয়াদ পাঁচ বছর হতে চলেছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ট্যানারি শিল্পনগরী বন্ধ করে দেওয়ার খবর প্রকাশ পেলে পরিবেশ অধিদফতর কারখানার পরিবেশগত ছাড়পত্র নবায়ন কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়। যদিও সংসদীয় কমিটির সুপারিশের আলোকে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। এ প্রসঙ্গে বিটিএ সভাপতি মো. শাহীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা আধুনিক চামড়াশিল্প নগরী চাই। ৩০ বছর আগের পরিকল্পনায় তৈরি ট্যানারি শিল্পনগরীতে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখন নেই। এখন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই নগরীতে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাই আমাদের মূল দাবি। এ ক্ষেত্রে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ যথাযথ দায়িত্ব পালন করেনি।’ এর আগে সাভারের হেমায়েতপুরের ট্যানারিশিল্প নগরী ২৩ আগস্ট বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এদিন কমিটির সভায় পরিবেশ অধিদফতর জানায়, প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার ঘন মিটার তরল বর্জ্য কোনো ধরনের শোধন ছাড়াই নদীতে ফেলা হয়, যে কারণে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সভা শেষে কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, ট্যানারি পল্লীতে প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার ঘন মিটার তরল বর্জ্য সৃষ্টি হয়। আর ট্যানারি পল্লীর বর্জ্য শোধনক্ষমতা প্রায় ২৫ হাজার ঘন মিটার। ফলে ১৫ হাজার ঘন মিটার তরল বর্জ্য কোনো ধরনের শোধন ছাড়াই নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। এই ট্যানারিশিল্পের কঠিন বর্জ্য শোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। কঠিন বর্জ্যরে মধ্যে রয়েছে ভারী ধাতু ও ক্রোমিয়াম। ফলে এ ধরনের ভারী বর্জ্য কোনো ধরনের শোধন ছাড়াই পানিতে ফেলা হচ্ছে। ট্যানারি পল্লী হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর করে কী লাভ হলো, যদি এখানেও পরিবেশের ক্ষতি সাধিত হয়? জানা গেছে, সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্প ৩০ জুন সমাপ্ত ঘোষণা করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। ২০০৩ সালে নেওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ ১২ দফা বাড়ানোর পাশাপাশি ১৭৫ কোটি টাকার পরিবর্তে ১০১৫ কোটি খরচ করা হলেও পরিবেশদূষণ বন্ধে কমন ক্রোম রিকভারি ইউনিট নির্মাণ সম্পন্ন হয়নি। এ ছাড়া সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে রিসোর্স জেনারেশনের ব্যবস্থাও রাখা হয়নি। প্রকল্পের আওতায় দুই বছরের মধ্যে সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (সিইটিপি) স্থাপন করার কথা থাকলেও তা শেষ হতে লেগেছে সাত বছরেরও বেশি সময়। কিন্তু সেই সিইটিপির পরিশোধন ক্ষমতা পিক সিজনে ট্যানারিগুলোর উৎপাদিত বর্জ্যরে মাত্র অর্ধেক। তাই সিইটিপিতে বর্জ্য পুরোপুরি ট্রিটমেন্ট হওয়ার আগেই তা ফেলে দেওয়া হচ্ছে। ট্যানারির কঠিন বর্জ্য পরিশোধনের কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। জানা গেছে, ইএসকিউ (এনভায়রনমেন্ট, সোশ্যাল অ্যান্ড কোয়ালিটি), আইএসও এবং অন্যান্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা জরুরি হলেও তা সম্ভব হয়নি। এখন চামড়া প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) বলছে, একটি পরিপূর্ণ চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলার জন্য যেসব বিষয় দরকার ছিল, তা প্রকল্পে সংযুক্ত ছিল না। এখন আরেকটি সিইটিপি স্থাপন, কঠিন বর্জ্য শোধন ব্যবস্থাসহ ব্যবসায়ীদের জন্য আরও প্লট তৈরি করতে বিদ্যমান ট্যানারি পল্লীর পাশে ২০০ একর জমিতে অপর একটি পল্লী স্থাপনের জন্য নতুন করে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে ডিটেইল প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।

সর্বশেষ খবর