রবিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ক্লুলেস হত্যার ক্লু আরও নয়জন খাব

মির্জা মেহেদী তমাল

ক্লুলেস হত্যার ক্লু আরও নয়জন খাব

শীতের সকাল। আরিচা ঘাটের পাবলিক টয়লেটের কাছে পার্ক করা রয়েছে একটি প্রাইভেট কার। কুয়াশায় ভেজা পুরো গাড়িটি। গাড়ির ব্যাকডালা থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। গাড়ির নিচে মাটিতে সেই রক্ত জমাট বেঁধেছে। পরিবহন শ্রমিকদের চোখে পড়ে সেই রক্ত। তারা গাড়ির সামনে গিয়েও দাঁড়াতে পারছে না। প্রচন্ড  দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে।

মালিকবিহীন গাড়িটি পড়ে আছে আগের দিন সন্ধ্যা থেকে। পরদিন দিনের বেলা তা থেকে পড়ছে রক্ত। পরিবহন শ্রমিকরা পুলিশকে খবর দেন। আসে মানিকগঞ্জের শিবালয় থানা পুলিশ। ব্যাকডালা ভাঙে। ভিতরে পুরুষের লাশ। মাথায় তিনটি পেরেক ঢোকানো। গলায় গুলির মতো ক্ষত। মুখে তুলা গোজা। নাক কেটে দেওয়া হয়েছে। পুরো শরির অ্যাসিডে ঝলসানো। পা দুটি পেছন দিক থেকে ভেঙে কাঠের সঙ্গে শক্ত করে হাতসহ বাঁধা। পরনে মোজা ও একটি অন্তর্বাস। লাশ ছিল বস্তাবন্দী। পিঠমোড়া বাঁধা লাশটি প্রথমে একটি পলিথিনে মুড়িয়ে দুই মণের চটের বস্তায় ভরে ফুল আঁকা একটি চাদর দিয়ে প্যাক করা ছিল। লাশটি এতটাই বিকৃত হয়ে আছে, আপনজন ছাড়া আর কেউ লাশটি শনাক্ত করা সম্ভব নয়। লাশটির সঙ্গে ছিল একটি চিরকুট। তাতে লেখা, এ লাশ নারায়ণগঞ্জের বাচ্চুর। বাচ্চুকে মারলাম। আরও ৯ জন খাব। ১৯৮৬ সালের নভেম্বরের ঘটনা এটি। লাশটি ছিল নারায়ণগঞ্জের নুরু মিয়া চৌধুরী বাচ্চুর। তিনি সেই সময়ে বাংলাদেশের ধনাঢ্য ব্যাবসায়ীদের মধ্যে ছিলেন একজন। বাচ্চুর লাশ এমনভাবে উদ্ধার হওয়ায় সারা দেশে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। নারায়ণগঞ্জে হরতাল পালন করা হয়। সকালে একটি ফোন কল পেয়ে খুব তাড়াতাড়ি ধানমন্ডির বাসা থেকে নিজ গাড়ি নিয়ে বেড় হয়েই নিখোঁজ হন বাচ্চু। সোবহানবাগ এলাকায় ড্রাইভার জাহাঙ্গীরকে নামিয়ে দিয়ে একাই তিনি গাড়ি নিয়ে যান। মোহাম্মদপুরে একটি বাসায় গিয়ে তিনি নিখোঁজ হন। ওই বাসাটি তিনি কাউকে চেনাতেন না। ড্রাইভারও চিনত না। দুপুরের ভিতর বাসায় ফেরার কথা থাকলেও বাচ্চু ফেরেননি। রাত পেরিয়ে নতুন দিন। পরের দিনও ফেরেননি। তারপরের দিন তার লাশ মেলে আরিচায়। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। ব্যবসায়িক দ্বন্দের জের ধরে তিনি খুন হতে পারেন বলে পুলিশের ধারণা। থানা পুলিশের পর এ মামলার তদন্ত করে সিআইডি। সিআইডি তদন্তে এগিয়ে না নিতে পারলে তদন্তের ভার দেওয়া হয় গোয়েন্দা পুলিশকে। গোয়েন্দা পুলিশও হয় ব্যর্থ। নারায়ণগঞ্জের অত্যন্ত প্রভাবশালী বাচ্চু খুনের বিষয়টি নিয়ে পুলিশ খুব একটা এগোতে পারে না। আর এ খুন নিয়ে চাঞ্চল্যকর বহু ঘটনার জন্ম দেয়। পত্র-পত্রিকায় একের পর এক উড়া চিঠি আসে। এ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি না করতেও হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এভাবেই মাসের পর মাস কাটে। বছর ঘুরে আসামি ধরা পড়ে না। মামলাটি ধামাচাপা পড়ে। এদিকে দেশের দুর্ধর্ষ একটি ডাকাত দলকে ধরতে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। গোয়েন্দাদের কাছে খবর রয়েছে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পতিতাপল্লীতে অবস্থান নিয়েছে সেই ডাকাত দল। এরা রাজধানী শুধু নয়, সারা দেশে ঘুরে ঘুরে ডাকাতি করে বেড়াচ্ছে। পুলিশের দল ঢাকা থেকে রওনা হয় গোয়ালন্দের উদ্দেশে। ভোরে তারা পৌঁছে যায় সেখানে। ছদ্মবেশে তারা পতিতাপল্লীর ভিতর। গোয়েন্দাদের অধিকাংশ সদস্য লুঙ্গি পরা। কারও মাথায় গামছা। প্রত্যেকেই সশস্ত্র। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন। বিভিন্ন কক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তাদের সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় সোর্স। ১৯৮৭ সালে গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরামের নেতৃত্বে ডাকাত দল অধীর আগ্রহে পতিতাপল্লীতে।

হঠাৎ এক সোর্স এসে এসি আকরামকে একটি তথ্য দেন। সোর্স জানান, সেখানে একজন নারী আছেন। নাম শিউলি। যার কাছে মূল্যবান একটি হীরার আংটি রয়েছে। এই হীরার আংটি ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছেন। মূল্যবান হীরার আংটি সম্পর্কে সেই নারীও জানেন না। এসি আকরাম বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে শিউলির সঙ্গে দেখা করেন। আকরামের দৃষ্টি যায় শিউলির হাতে। হ্যাঁ, দামি একটি হীরার আংটি তার আঙুলে শোভা পাচ্ছে। আকরাম তাকে প্রশ্ন করেন, ‘তোমার এ আংটি কোথা থেকে এনেছ?’ জবাবে শিউলি জানান, ‘তার প্রেমিক তাকে আংটি দিয়েছে। নাম বুড্ডা।’ এসি আকরামের কাছে বুড্ডা নামটি খুব পরিচিত। পেশাদার কিলার। ঢাকার বহু খুনে জড়িত সেই বুড্ডা। কখন আসবে বুড্ডা? জানতে চান আকরাম। শিউলি তাকে জানান, ঢাকায় আছে। সন্ধ্যার মধ্যে আসার কথা। এসি আকরাম তার পরিকল্পনা পাল্টে ফেলেন। ডাকাত নয়, তার দরকার এখন বুড্ডাকে। এসি আকরাম শিউলিকে জানান, তারা সেখানেই আছেন। বুড্ডার সঙ্গে তার প্রয়োজন। একটা কাজ করাবে তাকে দিয়ে। শিউলি বলেন, আপনারা থাকেন। বুড্ডা এলে আপনাদের খবর দেব। এসি আকরাম তার দলবল নিয়ে পতিতাপল্লী থেকে বেরিয়ে আশপাশে গিয়ে সময় কাটান। তারা নতুন করে পরিকল্পনা আঁটেন। গোয়েন্দাদের মাথায় তখন শুধু আংটি। কোথা থেকে এ দামি আংটি পেল। হয়তো কোনো তথ্য পাওয়া যেতে পারে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল। সন্ধ্যায় খবর আসে বুড্ডা চলে এসেছে। এসি আকরাম তার ফোর্স দিয়ে আবারও ঢুকে পড়েন পল্লীতে। শিউলির রুমে। বুড্ডা সেখানেই বসে আছে। আগে থেকে তাদের জন্য সেখানে খাওয়া-দাওয়ার বড় আয়োজন করে রেখেছে শিউলি। বুড্ডা তাকে দেখে বসতে বলে। কিন্তু এসি আকরামের চিন্তা, এখানে বেশি দেরি করা যাবে না। বুড্ডা মদপান করার আমন্ত্রণ জানায়। এসি আকরাম বলে, এগুলা পরে হবে। আগে আমাদের সঙ্গে চল। বুড্ডা মুখ তুলেই দেখেন তার চারদিকে ঘিরে ফেলেছে সশস্ত্র পুলিশ। বুড্ডা এবং শিউলিকে নিয়ে পুলিশ রওনা হয় ঢাকার উদ্দেশে। গাড়ির ভিতরেই জেরা শুরু। বুড্ডা এ সময় পুলিশের দলকে হুমকি দেয়। বলে, আপনারা চাকরি হারাবেন। বুঝতে পারছেন না, কাকে ধরেছেন। এসব কথা বলতে বলতেই গাড়ি ঢাকায়। গোয়েন্দা দফতরে নিয়ে জেরা করা হয়। আংটি কার? গোয়েন্দাদের প্রশ্ন। মুখ খোলে না বুড্ডা। যেন পন করে আছে, মুখ খুলবে না। কিন্তু এসি আকরামের মতো একজন চৌকস গোয়েন্দার কাছে মুখ না খোলার মতো অপরাধী নেই। কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে মুখ খুলতেই হয়। বুড্ডাকেও খুলতে হয়েছিল মুখ। গোয়েন্দারা যা জানতে পারল, তা ছিল কল্পনার বাইরে। ঘটনা শুনে গোয়েন্দারা স্তব্ধ। বিশ্বাস করতে পারছিল না। বুড্ডার তথ্য পেয়ে পুলিশ প্রশাসন শুধু নয়, সরকারের ভিতরেও তখন শুরু হয় তোলপাড়। সে স্বীকার করে, এ আংটি ছিল নারায়ণগঞ্জের বাচ্চুর। মোহাম্মদপুরের বাসায় তাকে মাথায় পেরেক ঠুকে হত্যা করা হয়েছিল। সে সময় বাচ্চুর আঙুল থেকে খুলে নেওয়া হয় সেই আংটি। সে পুলিশকে জানায়, এর পেছনে ছিল বাচ্চুর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ব্যবসায়িক পার্টনার। বুড্ডা আরও জানায়, মোহাম্মদপুরের আওরঙ্গজেব রোডের সেই ফ্ল্যাটটি বাচ্চুকে খুনের জন্য মাত্র এক দিনই ব্যবহার করেছিল। খুনের পর তারা আর ওই বাড়িতে যায়নি। বাচ্চুর ব্যবসায়িক পার্টনারের সঙ্গে দ্বন্দের  কারণেই তাকে খুনের এ মিশন দেওয়া হয়েছিল। যদিও বুড্ডা গ্রেফতারের পর সেই ব্যবসায়ী গা ঢাকা দেন। কিন্তু তিনি এক সময় ধরা পড়েন পুলিশের হাতে। সেই গল্প আরেক পর্বে।

 

সর্বশেষ খবর