মঙ্গলবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বোমা চেনাল ডাকাত দল

মির্জা মেহেদী তমাল

বোমা চেনাল ডাকাত দল

রাজধানীর ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের দিক থেকে একটি মাইক্রোবাস শরীফ ম্যানশন অতিক্রম করছিল। পূবালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে আসতেই একটি প্রাইভেটকার মাইক্রোবাসটির গতিরোধ করে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে যায়। দ্রুত প্রাইভেট কার থেকে অস্ত্র হাতে ৪/৫ জন যুবক নেমে পড়ে। এ সময় বিকট শব্দে বেশ কয়েকটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। গোটা এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। আতঙ্কে মানুষ এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে শুরু করে। মুহুর্তেই রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। ততক্ষণে প্রাইভেটকার থেকে নেমে ৪/৫ জন সশস্ত্র যুবক মাইক্রোটির ভেতরে থাকা লোকদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে টেনে রাস্তায় নামিয়ে নেয়। মাইক্রোটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সোজা চলতে শুরু করে পল্টনের দিকে। পেছনে পেছনে প্রাইভেট কারটিও মাইক্রোকে অনুসরণ করে চলে যায় দ্রুতগতিতে। মাটিতে লুটিয়ে পড়া মাইক্রোর যাত্রীগুলো চিৎকার করে বলতে শুরু করে ডাকাত ডাকাত। ততক্ষণে মাইক্রোটি হাওয়া। আর যা কিছু ঘটল মাত্র ২/৩ মিনিটের মধ্যেই। ঘটনাটি ১৯৮৯ সালের মার্চের এক সকালের। মাইক্রো থেকে নামিয়ে দেওয়া হতভাগা লোকগুলো গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের চিফ ক্যাশিয়ার, ড্রাইভার ও ক্যাশ পিয়ন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৫০ লাখ টাকা তুলে গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের ২ নং দিলকুশায় ফেরার পথেই ডাকাতের খপ্পরে পড়ে। তৎকালে প্রকাশ্যে ব্যস্ততম রাস্তা থেকে কোনো ব্যাংকের অর্ধ কোটি টাকা লুটের ঘটনা ওটাই ছিল প্রথম। এরশাদের শাসনামলে প্রকাশ্য দিবালোকে একটি বিদেশি ব্যাংকের টাকা লুটের ঘটনায় পরদিন দেশের সব সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়ে ওঠে। রাজধানীতে প্রকাশ্য দিবালোকে বোমা ফাটিয়ে ব্যাংকের টাকা লুটের ঘটনায় পুলিশের দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দেয়। ওই সময় ঢাকায় কূটনৈতিকপাড়া ছাড়া রাজপথে বা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কোনো সিসিটিভি ছিল না। রাজধানীতে এমন প্রকাশ্য ডাকাতির ঘটনা উদ্ঘাটন পুলিশের জন্য এক মহা চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়। এ ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব পড়ে গোয়েন্দা পুলিশের ওপর। যদিও ঘটনার পর থেকেই ছায়া তদন্ত করছিলেন গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা। আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পাওয়ার পর যেন ডাকাত ধরা কর্তব্য হয়ে গেল গোয়েন্দাদের। ঢাকাসহ সারা দেশের সোর্সদের মাধ্যমে এই ডাকাতির বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলেন গোয়েন্দারা। 

তৎকালীন গোয়েন্দা কর্মকর্তা এখন প্রত্যেকেই অবসর জীবনযাপন করছেন। তাদের বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে জানা যায় সেসব চাঞ্চল্যকর ঘটনায় তাদের গোয়েন্দাগিরির নানা তথ্য। তাদের একজন জানান, সেই সময় পুলিশ অপরাধের ধরন দেখে এলাকাভিত্তিক অপরাধীদের কর্মকান্ড বিশ্লেষণ করে সন্দেহভাজনদের আটক করে রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা হতো। পুলিশ অফিসারদের ফিল্ডে কাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা, সোর্সদের তথ্যের সত্যতা, সন্দেহভাজন অপরাধীর কর্মকান্ড, গতিবিধি, ঘটনার সময় তার অবস্থান, কোন কোন অপরাধীকে ঘটনার পর থেকে এলাকায় প্রকাশ্যে দেখা না যাওয়াসহ পুরনো ডাকাতির ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করা হতো। নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেই মামলার তদন্তকাজ চালানো হতো। ছিল না কোনো মোবাইল কললিস্ট, কল শনাক্তকরণের যন্ত্রপাতি। শুধু অফিসারদের মেধা, বুদ্ধি, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা আর মহান সৃষ্টিকর্তার সহায়তার ওপর ভরসা করে পুলিশকে কাজ করতে হতো।

তৎকালীন গোয়েন্দারাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। মতিঝিলের ডাকাতির বিষয়টি গোয়েন্দা কর্মকর্তা এসি আকরাম হোসাইন চুলচেরা বিশ্লেষণ করছিলেন। যে কোনো ক্লুলেস মামলার রহস্য উদঘাটনে তার ছিল দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ও মনোবল। গোয়েন্দারা জানতেন, ঢাকায় বোমা আর অস্ত্রের ব্যবহার কারা করেন। এসব ডাকাতির ঘটনায় বোমার ব্যবহার করেন এমন ডাকাতদের তালিকা তৈরি করলেন। আর এই ডাকাতদের অবস্থানও গোয়েন্দারা ওয়াকিবহাল। ঢাকার অপরাধীদের অপরাধের ধরন বিশ্লেষণে এমনই এক ডাকাতের তথ্য এলো পুরান ঢাকা থেকে। আর কালবিলম্ব নয়। শুরু হলো অপারেশন। হাজারীবাগ গজমহল বস্তি থেকে বাচ্চু নামের ডাকাতকে গ্রেফতার করে অভিযানের যাত্রা শুরু করা হলো। এই বাচ্চু বোমার ব্যবহার বেশি করতেন। আগ্নেয়াস্ত্র খুন-খারাবিতে ব্যবহার করতেন। বাচ্চুর দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে গভীর রাতেই মোহাম্মদপুরের কাটাসুর বস্তিতে অভিযান চালানো হলো। ডাকাতদের সঙ্গে গোলাগুলির পর জজ মিয়াকে গ্রেফতার করা হলো। তার দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে একটানা ৯৬ ঘণ্টার অভিযানে ঢাকার পলাশীর ঢাকেশ্বরী মন্দির এলাকা থেকে গনি ওরফে কানা খোকাকে আটক করা হয়। তাকে ডিবি অফিসে জেরা করা হয়। এ সময় ঢাকার ফুলবাড়িয়ার পরিবহন শ্রমিক নেতা সুলতান রেজার ভাই হিরু রেজা ডিবি অফিসে নিয়মিত যাতায়াত করে এই ডাকাতির খোঁজখবরে বেশি উৎসাহ দেখায়। তাই এসি আকরাম গোপনে তার প্রতি নজরদারি বাড়িয়ে দেন। একপর্যায়ে ডাকাতিতে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়, তাকেও আটক করা হয়। এরপর আবারও একটানা অভিযান। ঢাকা, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর জেলায় অভিযান চালিয়ে সাতজন ডাকাত আটক করা হয়। তাদের স্বীকারোক্তিতে মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর থানার প্রত্যন্ত চর এলাকার এক ডাকাতের শ্বশুরবাড়িতে ডাকাতির টাকা রাখার তথ্য পাওয়া যায়। শুরু হয় মানিকগঞ্জের ঘিওরে অভিযান। সেই ডাকাতের শ্বশুরবাড়িতে কাঠের সিন্দুক থেকে একটি ব্রিফকেস উদ্ধার করা হয়। ওই ব্রিফকেসেই ব্যাংকের স্লিপ লাগানো ডাকাতির ৪৯ (ঊনপঞ্চাশ) লাখ নব্বই হাজার টাকা পাওয়া যায়। উদ্ঘাটিত হয় চাঞ্চল্যকর গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের ডাকাতির রহস্য। পুলিশ প্রশাসনে ফিরে আসে স্বস্তি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর