সাভারে হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরীর বর্জ্যে আশপাশের ছয়টি নদ-নদীর পানি মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়েছে। ট্যানারির বর্জ্যে এসব নদ-নদীর পানিতে সৃষ্টি হচ্ছে দুর্গন্ধ। নদীর পাড় ও আশপাশের মানুষজনের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। চামড়া শিল্পনগরীর বর্জ্যে বংশী, ধলেশ্বরী, কালীগঙ্গা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদের পানি দূষিত হচ্ছে। এর মধ্যে বংশী ও ধলেশ্বরীর পানি দূষিত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এ দুই নদীর সঙ্গে অন্য চার নদ-নদীর সংযোগ থাকায় সেগুলোর পানিও দূষিত হচ্ছে। এসব নদীতে মাছ নেই বললেই চলে। জলজ উদ্ভিদের অস্তিত্বও বিপন্ন। নদীপাড়ের স্বল্প আয়ের মানুষের জীবিকা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাতাসেও ছড়িয়ে পড়ছে বর্জ্যরে দুর্গন্ধ। চারপাশের পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। দূষিত পানি ব্যবহার করে অনেকে চর্মরোগ ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হচ্ছেন।

এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মানুষের সচেতনতা এবং সরকারি সমন্বি^ত উদ্যোগের মাধ্যমে শুধু নদী দূষণ তথা পরিবেশ বিপর্যয় কমানো সম্ভব। এ বিষয়ে সরকার শিগগিরই উদ্যোগ নেবে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বর্ষা ও বন্যার কারণে পানির দূষণ কম দেখা যাচ্ছে। ট্যানারির বর্জ্য সরাসরি পড়ছে বংশী নদীতে। এখান থেকে ধলেশ্বরীতে যাচ্ছে। এর সঙ্গে বাকি চার নদ-নদীর সংযোগস্থল পর্যন্ত পানিও ঘোলাটে। ভরা বর্ষায়ও নদীতে কোনো মাছ নেই। আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্ষার কারণে পানিতে দুর্গন্ধ কম। পানির রংও অনেকটা স্বাভাবিক। তারা জানান, বর্ষার পরই পানি কালো হয়ে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়ায়। দুর্গন্ধে অনেকের শ্বাসকষ্ট হয়। চর্মরোগও দেখা দেয়। আগে এগুলোর প্রকোপ ছিল না। বিসিক জানায়, শিল্পনগরীতে ১৫৫টি কারখানা কার্যক্রম শুরু করেছে। কারখানায় তরল, কঠিন ও বায়বীয় তিন ধরনের বর্জ্য উৎপন্ন হয়। প্রতিদিন যে পরিমাণ তরল বর্জ্য উৎপন্ন হয়, সেগুলো পরিশোধনের ব্যবস্থা নেই। এগুলো পরিশোধনের জন্য কমপক্ষে দুটি কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) স্থাপনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু স্থাপন করা হয়েছে একটি। তরল বর্জ্য শোধনাগার সিইটিপি সার্বক্ষণিক সচল থাকে না। এ ছাড়া নতুন নতুন কারখানা চালু হওয়ায় চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা বেড়েছে। ফলে বর্জ্যরে পরিমাণও বেড়েছে। কিন্তু একটি সিইটিপি দিয়ে সব বর্জ্য পরিশোধন করা সম্ভব হচ্ছে না। এগুলো কারখানা থেকে বিভিন্ন নালা দিয়ে পাশের ধলেশ্বরীতে গিয়ে পড়ছে। এর মধ্যে আছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ক্রোমিয়াম, ক্লোরিন, নাইট্রিক অক্সাইড, সালফিউরিক অ্যাসিড, কার্বনসহ নানা রাসায়নিক দ্রব্য, যা মানবদেহে শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সার, চর্মরোগের সৃষ্টি করে।

সরেজমিন চামড়া শিল্পনগরীর পাশে বংশী ও অদূরে ধলেশ্বরীর আশপাশ ঘুরে দেখা গেছে, পোশাক কারখানা ও ট্যানারির বর্জ্যে পানির রং কালো কুটকুটে। বংশী ও ধলেশ্বরী নদ-নদী দূষণের ৮০ শতাংশই হচ্ছে ট্যানারির বর্জ্য।ে বাকি ২০ শতাংশ হচ্ছে অন্যান্য শিল্প বর্জ্য।ে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শিল্পনগরী থেকে মাটির নিচ দিয়ে শতাধিক প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমে বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। নদীতীরের বাসিন্দা নাসির উদ্দিন (৭০) বলেন, শুধু মাছ ধরা নয়, প্রয়োজনীয় অনেক কাজে ছয় বছর আগেও নদীর পানি ব্যবহার করতেন সবাই। এখন নদীর পানি কোনো কিছুতেই ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। এমনকি গরুও গোসল করানো যায় না। ধলেশ্বরী নদীর পানি আগে কেমন ছিল জানতে চাইলে নদীপাড়ের বাসিন্দা নুরুন নাহারের চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। বয়োবৃদ্ধ নুরুন নাহার বলেন, ‘পানি আগে এতটাই স্বচ্ছ ছিল যে নদীর তলার বালি দেখা যেত। চিতল ও ফলি মাছ ধরতে নদীর এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত নৌকা নিয়ে ছুটতাম। আগে অগণিত জেলে সারা বছর মাছ ধরেও শেষ করতে পারত না। এখন তো নদীতে মাছও নেই, জেলেপাড়াও নেই। আছে শুধু দখলদারদের বড় বড় কারখানা।’

তিনি জানান, বর্ষার দুই মাস ছাড়া পুরো বছর পানিতে এত দুর্গন্ধ থাকে যে নাকে রুমাল দিয়ে চলাচল করতে হয়। এ বিষয়ে পরিবেশবিদ সামসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে সরকার চামড়াশিল্প নগরী সাভারে নিয়েছে। কিন্তু তদারকি ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না করায় এখন সাভার ও আশপাশের ছয়টি নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতরও নির্বিকার। মাঝেমধ্যে শুধু দু-একটি চিঠি ইস্যু করেই দায়িত্ব শেষ করছে। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হুমায়ুন কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পরিবেশ রক্ষায় প্রশাসনের পক্ষে যতটুকু ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব তা করা হচ্ছে। নদী রক্ষায় শিগগিরই প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। দূষণে দায়ী এমন প্রমাণ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দোষী কাউকেও ছাড় দেওয়া হবে না। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিল্পনগরী স্থাপনের সময় পরিকল্পনায় ত্রুটি ছিল। হাজারীবাগের কাঠামো বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু নতুন কারখানা হলে উৎপাদন বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। ফলে বর্জ্য বেশি হচ্ছে। এগুলো পরিশোধন করা যাচ্ছে না। ডাম্পিং ইয়ার্ডেও জায়গা হচ্ছে না। চামড়াশিল্প নগরীর প্রকল্প পরিচালক জিতেন্দ্র নাথ পাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পে যে উৎপাদন ছিল, ওই হিসাব অনুযায়ী সাভারের শিল্পনগরীর নকশা করে সিইটিপি স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে প্রায় সব কারখানাই আগের তুলনায় উৎপাদন তিন থেকে পাঁচ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বর্জ্য বেশি উৎপন্ন হচ্ছে। এ কারণে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, এ সমস্যা সমাধানের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।