বুধবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

স্যান্ডেলে মিলল কঙ্কালের পরিচয়

মির্জা মেহেদী তমাল

স্যান্ডেলে মিলল কঙ্কালের পরিচয়

বাবার বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন গৃহবধূ কুলসুম বেগম। বিভিন্ন স্থানে খুঁজেও পাওয়া যায়নি তাকে। তার স্বামী ইকবাল শেখের সঙ্গে খুব একটা ভালো সম্পর্ক ছিল না। তিনি একটি ধর্ষণ কারাগারে রয়েছেন। এ অবস্থায় কুলসুম নিখোঁজ হলে পারিবারিকভাবেই বিষয়টি চেপে যাওয়া হয়। কুলসুমের বাবা আলী আকবর মোড়ল এবং পরিবারের অন্যদের ধারণা, সংসার জীবনে ত্যক্তবিরক্ত কুলসুম হয়তো নিজে থেকেই অন্য কারও সঙ্গে চলে গেছেন। নতুন সংসার পেতেছেন।

সময়মতো চলে আসবেন। এ কারণে থানা পুলিশকেও নিখোঁজ বিষয়টি জানানো হয়নি। ঘটনাটি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার পূর্ব হাসারাগাঁওয়ের। চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি কুলসুম বেগম শ্রীনগরে বাবার বাড়ি থেকে পাশের গ্রামেই নিজের বাড়ি ফিরছিলেন। এর পর থেকে তার খোঁজ নেই। কুলসুমের মোবাইল ফোনও ছিল বন্ধ। তার ছেলে অয়ন বারবার কল দিয়ে ব্যর্থ হয়। মাকে খুব দরকার। কারণ তার বাবার জামিনের জন্য মেডিকেল সার্টিফিকেট প্রয়োজন; যা কি না তার মায়ের কাছে রাখা আছে। মায়ের ফোন বন্ধ থাকায় পরদিন অয়ন নানার ফোনে কল দেয়। বলে, ‘বাবার জামিনের জন্য মেডিকেল সার্টিফিকেট দরকার। সার্টিফিকেট তো মায়ের কাছে আছে। মায়ের ফোন বন্ধ। একটু মাকে ফোনটা দাও।’ অয়নের নানা বলেন, ‘তোর মা তো গতকালই বাসার কথা বলে বের হয়েছে। ফোন তো বন্ধ থাকার কথা না।’ এ কথা শুনে ফোন রেখে দেয় অয়ন। অয়ন ও তার ছোট বোন মিলে বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের কাছে খবর নেয়। কোথাও পায় না তাদের মাকে। তাদের ধারণা ছিল মা হয়তো কোথাও চলে গেছেন। যে কারণে তারা খোঁজখবর নেওয়া বন্ধ করে দেয়। নানার পরামর্শে তারা থানা পুলিশকেও জানায়নি। অয়ন চলে যায় তার কর্মস্থল মানিকগঞ্জে। বোন অরিনকে রেখে যায় নানার কাছে। মায়ের অপেক্ষায় অরিন বসে থাকে নানাবাড়ির উঠানে। কিন্তু মায়ের খোঁজ নেই। দিন কাটে, সপ্তাহ পেরিয়ে যায়। মায়ের ফোন নেই, খবরও নেই। হঠাৎ একদিন পুরো গ্রামে শোরগোল। কঙ্কাল পেয়েছে পুলিশ। গ্রামেরই একটি মাঠের কোনায় কঙ্কালটি ঘাসের স্তুপের নিচে ঢাকা ছিল। পুলিশ এখনো সে মাঠে রয়েছে। মানুষের মুখে মুখে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রামে। খবর যায় আকবর আলীর কাছেও। খবর পায় ছোট্ট শিশুকন্যা অরিনও। সবার মতোই উৎসাহী হয়ে আকবর আলী সে মাঠের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। অরিনও বায়না ধরে নানার সঙ্গে যাবে। কারণ মানুষ দল বেঁধে ছুটে যাচ্ছে মাঠের দিকে কঙ্কাল দেখতে। আকবর আলী অরিনকে নিয়ে মাঠের দিকে যান। প্রচুর ভিড়। পুলিশ ততক্ষণে কঙ্কালটি উদ্ধার করে মাঠের ওপর রেখেছে। সেখান থেকে স্যান্ডেল, মাথার ক্লিপ ও ছেঁড়া কাপড়ের অংশ আলাদা করে রাখা। উপস্থিত গ্রামবাসীর কাছে পুলিশের প্রশ্ন- আপনারা কেউ চিনতে পারছেন এ কাপড়, স্যান্ডেল আর ক্লিপ? পুলিশ নিশ্চিত এটি নারীর কঙ্কাল। কঙ্কালের পাশেই নারীর পরিধেয় মালামালও উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ জানার চেষ্টা করছে কেউ চিনতে পারছে কি না। এ সময় নানার হাত ধরে কঙ্কালের পাশে রাখা মালামালের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে অরিন। স্যান্ডেল দেখেই অরিন চিৎকার করে বলে, ‘ও নানা, এটা তো মায়ের স্যান্ডেল!’ আকবর আলীও ভালো করে দেখেন ক্লিপ, ছেঁড়া কাপড়। তিনিও চিনতে পারেন। কারণ তার বাসা থেকেই কুলসুম বেরিয়েছিলেন সেই কাপড় পরে। খবর পেয়ে মানিকগঞ্জ থেকে ছুটে আসে কুলসুমের ছেলে অয়ন। অয়নও চিনতে পারে তার মায়ের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। নিখোঁজের ২০ দিন পর অয়ন-অরিনের মায়ের কঙ্কাল উদ্ধার হলো। তা-ও তাদের বাবার মাঠে। ঢাকা ছিল ঘাসের স্তুপে।

অয়ন এবার থানায় মামলা করে। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। কঙ্কাল উদ্ধারের দুই দিন পর ৭ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্তভার ন্যস্ত হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর ওপর। পিবিআই তদন্ত শুরু করে।

তদন্ত করতে গিয়ে প্রথমেই কুলসুমের ফোনের কললিস্ট বের করে। সেখানে দেখতে পায় সুমন শেখ নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার ফোনে নিয়মিত কথা হতো। নিখোঁজ যেদিন হয়েছেন সেদিনও ওই নম্বরে কথা বলেছেন সুমন। পুলিশের সন্দেহ সুমনকেই। ১৮ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টার দিকে সিরাজদিখান উপজেলার রামকৃষ্ণদি বাজার এলাকা থেকে পিবিআই গ্রেফতার করে সুমনকে। তাকে বেশি চাপাচাপি করতে হয়নি পুলিশকে। প্রথম জেরাতেই মুখস্থ নামতার মতো গড়গড় করে সব বলে দেন সুমন। জানান, তিনি বিদেশে থাকতেই ফোনে পরিচয় হয় কুলসুমের সঙ্গে। বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসার পর কুলসুমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না থাকার সুযোগ নিয়ে সুমন তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাদের মধ্যে সম্পর্ক দিন দিন আরও ঘনিষ্ঠ হয়। ছেলেকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে কুলসুমের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা নেন সুমন। এ টাকার বেশির ভাই সুদে নেওয়া। কিন্তু ছেলেকে বিদেশে পাঠানো দেরি করায় টাকা ফেরত চান কুলসুম। সুমন তাকে ৮০ হাজার টাকা ফেরত দেন। বাকি টাকার জন্য কুলসুম চাপ দিতে থাকেন। কারণ কুলসুমের টাকার সুদ বাড়ছিল। এ অবস্থায় সুমন কুলসুমকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটেন। ফোন করে কুলসুমকে বাইরে ডেকে নেন। সেখানে নিয়ে ধারালো চাপাতি দিয়ে তার মাথা ও ঘাড়ে আঘাত করেন। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান কুলসুম। লাশ মাঠের কোনায় নিয়ে ঘাসের স্তুপের নিচে রেখে দেন। আর ভ্যানিটি ব্যাগটি পাশের একটি পুকুরে ফেলে দেন। পরে সুমনকে নিয়ে সেই পুকুরে আলামত উদ্ধারে অভিযান চালান পিবিআই সদস্যরা। অভিযানে পুকুর থেকে কুলসুমের ব্যবহৃত ভ্যানিটি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। ব্যাগে সাড়ে ৫ হাজার টাকা, ছেলে অয়নের জাতীয় পরিচয়পত্র, একটি ভ্যাসলিন, চিরুনি, ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র, এনজিওর সদস্য বই ইত্যাদি পাওয়া যায়।

সর্বশেষ খবর