শুক্রবার, ১ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

রুম নম্বর ২০৯

মির্জা মেহেদী তমাল

রুম নম্বর ২০৯

গোয়েন্দা কর্মকর্তার কাছে একটি সংবাদ আসে চিরকুটে। তাতে লেখা ঢাকায় হেরোইন বা ব্রাউন সুগারের চালান নিয়ে দুই পাকিস্তানি ঢাকায় অবস্থান করছে। একটি আবাসিক হোটেলে থেকে তারা হেরোইনের চালান হাত বদল করছে। এমন তথ্য পেয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তা একটু নড়েচড়ে বসেন। হোরোইনের চালান নিয়ে বাংলাদেশে কেউ এসেছে এমন ঘটনা এর আগে কখনো শুনেনি, ঘটেওনি। ১৯৮৪ সালে দুই পাকিস্তানির হেরোইন পাচারের ঘটনাটি শুনে গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে ভাবিয়ে তুলে। তিনি পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তার ওপরই দায়িত্ব পড়ে চোরাচালান চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করার। গোয়েন্দা কর্মকর্তা এও জানেন, যারা হেরোইন চোরাচালান করেন, তারা সাধারণ কোনো লোক নয়। আন্তর্জাতিকভাবে তাদের যোগাযোগ অবশ্যই রয়েছে। অস্ত্রশস্ত্র তাদের কাছে থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। এমন সব ভাবছেন আর অভিযানের পরিকল্পনা করছেন গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা এসি আকরাম হোসাইন। ওই সময় ঢাকায় এ ধরনের নেশাদ্রব্য কারও কাছ থেকে পাওয়া না যাওয়ায় এই নতুন মাদক সম্পর্কে সবাই অপরিচিত। তবুও এই নেশার বিস্তার ঘটতে শুরু করেছিল বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায়। যদিও মরণনেশা হেরোইনের ছোবল সম্পর্কে একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে আগে থেকেই এসি আকরামের ধারণা ছিল। তাই ঢাকায় হেরোইনের প্রবেশ ও দুই পাকিস্তানির অবস্থানের বিষয়টিকে তিনি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে খোঁজখবর শুরু করেন। সোর্সের সংবাদের সত্যতাও পেয়ে গেলেন তিনি। ঢাকার মগবাজারের সুরমা আবাসিক হোটেলে ওই দুই পাকিস্তানি অবস্থান করার বিষয়টি নিশ্চিত হলেন। এবার অভিযানের পালা। আগেই হোটেল ম্যানেজারের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন পাকিস্তানিরা ২০৯ নম্বর রুমটিতে অবস্থান করছেন। সারা দিনই তারা রুমে থাকেন। খুব একটা বের হন না। নতুন অ্যাসাইনমেন্ট। আগে কখনো এ ধরনের অভিযানে যাননি তারা। একদল গোয়েন্দা তাই অস্থির সময় পার করছেন। অভিযানের আগে ঢাকার মিন্টো রোডের গোয়েন্দা দফতরে শেষ পরামর্শ দিচ্ছেন এসি আকরাম। সংক্ষিপ্ত মিটিং শেষে দুটি গাড়ি নিয়ে সাত-আটজনের গোয়েন্দা দল বেরিয়ে পড়লেন। মিন্টো রোড থেকে বেশি দূর নয়। কাছাকাছি। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলেন তারা। হোটেল সুরমা। দোতলায় একটি রুম বাদে সব রুম ভাড়া করে নিলেন গোয়েন্দারা। প্রতিটি রুমেই অবস্থান নিলেন এসি আকরামের সদস্যরা। রুমে সাদা পোশাকে ডিবি সদস্যরা বোর্ডার সেজে অবস্থান করছিলেন। টার্গেট ছিল মাল ডেলিভারির সময় দেশীয় মাদক ব্যবসায়ীসহ হাতেনাতে আটক করা। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে রাত হয়ে এলেও মাল নিতে কেউ আসছিল না। তাই তাদের কাছে যে মরণনেশা হেরোইনের চালান আছে এটাও শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। পাকিস্তানিদের রুমে খাবার নিয়ে যে বয়গুলো যাতায়াত করে তাদের কাছ থেকে জানতে পারলেন ওরা রুমের ভিতরে যেতে দেন না। ওরা দরজা খুলে নিজেরাই খাবার ভিতরে নিয়ে যান। মাত্র দুই দিন তাদের অবস্থান হলেও একজন হুজুর ছাড়া আর কেউ তাদের সঙ্গে দেখা করেননি। জানতে পারলেন এসি আকরাম হোসাইন। ৮-১০ ঘণ্টায় তিনিও আসছেন না। রাত গভীর হওয়ার আগেই সিদ্ধান্ত নিলেন অপারেশনের। রুম নম্বর ২০৯। বারান্দা, হোটেলের পেছনসহ সাদা পোশাকে ঘিরে রাখলেন হোটেল সুরমা। হোটেলের বয়দের দিয়ে দরজা নক করালেন। পাকিস্তানি দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে পিস্তল উঁচিয়ে রুমে ঢুকে যান এসি আকরাম এবং তার সহযোগীরা। তাদের রুমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই পাকিস্তানিকে আলাদা আলাদা বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। তারা একপর্যায়ে স্বীকার করলেন পাকিস্তান থেকে মাদকদ্রব্য হেরোইন আনার কথা। তাদের কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে মাসকিন টেপ দিয়ে মোড়ানো বড় বড় দুটি প্যাকেটে উদ্ধার করা হলো মাদক হেরোইন। আটক করা হলো দুই পাকিস্তানি নাগরিককে। ল্যাবে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন আটককৃত দুই প্যাকেট মাদকদ্রব্য হেরোইন, যা ব্রাউন সুগার নামে পরিচিত। দেশের বৃহৎ প্রথম মাদক হেরোইনের চালান। পরে দুই পাকিস্তানির মধ্যে আজিজ খানকে জিজ্ঞাসাবাদ ও অনুসন্ধান চালিয়ে বাড্ডা ও টঙ্গি থেকে মওলানা মতিন নামে একজনকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে মতিন জানিয়েছিলেন, তাকে দোভাষী হিসেবে তারা রেখেছিলেন। কিন্তু এই হেরোইনের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না এবং তার সাহায্যে বাংলাদেশের কারও সঙ্গে গত দুই দিনে কথা হয়নি। দেশের সর্বপ্রথম হেরোইনের চালান আটকের স্বীকৃতিস্বরূপ দুবাইতে ৮৮টি দেশের মাদকবিরোধী সম্মেলনে কান্ট্রি চিফ হিসেবে আকরাম হোসাইন বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ওই সম্মেলনে পাকিস্তান থেকে এসেছিলেন একজন ডিআইজি। আদালতের অনুমতি নিয়ে ঢাকায় ডিবি অফিসের পেছনের খোলা জায়গায় গর্ত করে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে হেরোইন ধ্বংস করা হয়।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর