শনিবার, ২ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

বিদেশিনীর দুই পা ছিল অস্বাভাবিক মোটা

মির্জা মেহেদী তমাল

বিদেশিনীর দুই পা ছিল অস্বাভাবিক মোটা

ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। রাতে ফ্লাইট কম থাকায় যাত্রীদের চাপ কম। শুধু লন্ডনগামী যাত্রীদের লম্বা লাইন। বোর্ডিং কার্ড নিচ্ছেন। লাইনের পেছনের দিকে দাঁড়ানো এক মার্কিন তরুণী। হাতে পাসপোর্ট। কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ, কোমর পর্যন্ত ঝোলানো। শীততাপ নিয়ন্ত্রণের মধ্যেও তিনি ঘামছেন। টিস্যু দিয়ে কপাল, মুখ মুছছেন। অস্থির। বারবার লাইন ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। সামনের দিকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন। তার চোখ যাচ্ছে বারবার কাস্টমস কর্মকর্তা আর কাচঘেরা রুমের দিকে। সেখানে যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশি চলছে। সন্দেহ হলেই গোপন কক্ষে নিয়ে যাত্রীর পুরো শরীর তল্লাশি করা হয়। লাইন সামনে এগোচ্ছে। কিন্তু তিনি এগোচ্ছেন না। লাইন থেকে হঠাৎ বেরিয়ে যান। আশপাশে চোখ ঘুরিয়েই টয়লেটের দিকে পা বাড়ান। চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। টয়লেটে আয়নার সামনে দাঁড়ান। মুখে পানির ঝাপটা দেন। কী করবেন বুঝতে পারছেন না! শরীরে বেঁধে রাখা জিনিসগুলো ফেলে দেব? সে-ই ভালো। নতুবা আজ নির্ঘাত ধরা পড়তে হবে। শরীরে বাঁধা জিনিসগুলো সরিয়ে ফেলার চেষ্টা চালান। কিন্তুহাত কাঁপছে। খুলতেই পারছেন না। চেষ্টা করতে করতেই বেশ খানিকটা সময় চলে গেছে। ইতিমধ্যে টয়লেটে আরও লোকজনের আনাগোনা। সে কাজটি আর করা হলো না। তিনি নিশ্চিত টয়লেট থেকে বেরোনোর পরই তার দেহ তলাশি করা হবে। ভয়ে ভয়ে টয়লেট থেকে বেরিয়ে আসেন। কাস্টমস কর্মকর্তারা তখন একজন যাত্রীর ব্যাগ-দেহ তলাশি করছেন। তার দিকে কারও নজর নেই। এই তো সুযোগ! ধুকধুক বুক নিয়েই কাস্টমস এলাকা অতিক্রম শুরু করেন। এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু পা দুটি ভীষণ ভারী লাগে। স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না। কিছুটা হেলেদুলে হাঁটেন। দেহের নিচের দিক দেখতে বেখাপ্পা লাগে। দুই রান দেহের তুলনায় বেশ মোটা মনে হয়। এর পরও হাঁটেন। পেছনে তাকান না। সিদ্ধান্ত নেন পেছন ফিরে তাকাবেন না। কিন্তু কোনো কণ্ঠ শুনলেই মনে হয় বুঝি পেছন থেকে ডাকছেন কেউ। নাঃ কেউ ডাকেন না। মনে মনে নিজেকে ধন্যবাদ দেন। ভয়ের বাধা অতিক্রম করে ফেলেন তিনি। এখন শুধু সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে পারলেই হয়। রানওয়েতে গাড়ি আছে। সেটায় উঠেই হিথ্রোগামী উড়োজাহাজের দরজার কাছে চলে যাবেন। আর পায় কে! সিঁড়ি বেয়ে নামেন তিনি। একটু মোড় ঘুরে আবারও নিচের দিকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। আঃ বাঁচা গেল! খুশিতে কান্না পেল। হ্যালো! মহিলার কণ্ঠ। তরুণীটি ভাবেন তিনি ভুল শুনছেন। কানে না নিয়ে চলতে লাগলেন। হ্যালো মিস! এবার একটু জোরেই ডাকা হলো পেছন থেকে। এবার থামলেন। পেছনে তাকাতেই দেখেন কাস্টমস কর্মকর্তা তাকেই ডাকছেন। হ্যাঁ আপনাকেই, বলে ইশারায় তাকে ওপরে উঠে আসতে বলেন। অপ্রস্তুত একদম। মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসেন। দরদর করে ঘামছেন। মহিলা কর্মকর্তা তার দিকে সন্দেহ নিয়ে তাকান। তার চোখ দেহের নিচের দিকে। কাছাকাছি আসতেই মহিলা মুখে হাসি নিয়ে বললেন, হ্যালো, হাউ আর ইউ? তরুণীর মুখ থেকে কোনো শব্দই বের হয় না। তাকে নিয়ে গেলেন গোপন কক্ষে। দেহ তল্লাশি হবে। তল্লাশি চালাতেই কাস্টমস কর্মকর্তার চোখ কপালে। দুই রানে স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো বেশ কয়েকটি প্যাকেট। খুলে পরীক্ষা করে দেখা যায় হেরোইন। সাড়ে ৩ কেজি! গ্রেফতার হন অষ্টাদশী মার্কিন তরুণী। তার দুই পা অস্বাভাবিক মোটা দেখানোর কারণেই কাস্টমস কর্মকর্তারা ধরে ফেলেন তাকে।

২৯ বছর আগে এভাবেই দেহের সঙ্গে সাড়ে ৩ কেজি হেরোইন বেঁধে দেশত্যাগের চেষ্টা করেন নিষ্পাপ চেহারার মার্কিন নাগরিক অষ্টাদশী এলিয়েদা মেকর্ড লিয়া। অল্পের জন্য ধরা পড়ে যান। ১৯৯২ সালের এ ঘটনাটি দেশে-বিদেশে তোলপাড় হয়। কাস্টমস কর্মকর্তাদের জেরায় এলিয়েদা বলেন তার মাদক পাচারে জড়িয়ে পড়ার আদ্যোপান্ত।

১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে এক মাসের শিক্ষা ভিসা নিয়ে ঢাকায় আসেন এলিয়েদা। তাকে বিমানবন্দর থেকে একটি পাঁচ তারকা হোটেলে নিয়ে যান মাদকের সরবরাহকারী নাইজেরিয়ার নাগরিক রবার্ট বাংকসন টনি। টনি পরে তার সঙ্গে দেখা করবেন বলে হোটেলে রেখে চলে যান। এদিকে এলিয়েদার দিন কাটতে থাকে হোটেলের রুমে শুয়েবসে। এভাবেই প্রায় দুই সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পর অস্থির হয়ে পড়েন তিনি। দেশের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে বাবা-মায়ের কথা। মনের ভিতর তখন থেকে তার অজানা আশঙ্কা। ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে সিদ্ধান্ত নেন কাউকে কিছু না বলে হোটেল থেকে বেরিয়ে দেশে ফিরে যাবেন। পরদিন দুপুরে এলিয়েদা ব্যাগ গুছিয়ে নেন। নিজের রুম থেকে বেরিয়ে পড়েন। হোটেলের লবিতে যাওয়া মাত্র একজন বেলবয় তাকে সাহায্য করতে ছুটে আসেন। ব্যাগ তাকে দিয়ে সামনে চোখ রাখতেই দেখেন মাদকের ডিলার টনিকে। টনি তার সামনে এসে দাঁড়ান। প্রশ্ন করেন, কোথায় যাচ্ছ? এলিয়েদার জবাব, আমি আর দেরি করতে পারছি না। নইলে ফ্লাইট মিস করব। টনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তার হাত ধরে হোটেলের বাইরে নিয়ে যান। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাড়িতে জোর করে তুলে নেন। টনি তাকে ভয় দেখিয়ে বলেন, টেক্সাসে তার ছোট ভাইয়ের ক্ষতি হয়ে যাবে তার কথামতো না চললে। লিয়াকে নিয়ে যান আরও একটি হোটেলে। সেখানেই টেপ দিয়ে লিয়ার দেহের সঙ্গে সাড়ে ৩ কেজি হেরোইন পেঁচিয়ে দেন টনি। সাড়ে ৩ কেজি ওজনের হেরোইন শরীরে বেঁধে চলতে খুব সমস্যা হচ্ছিল তার। এলিয়েদা এ সময় টনির কাছ থেকে পারিশ্রমিক ১০ হাজার ডলার দাবি করেন। কিন্তু টনি তাকে আশ্বাস দেন। বলেন টেক্সাসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডলার পেয়ে যাবে। এলিয়েদা বুঝতে পারেন প্রতারিত হয়েছেন। এর পরই তাকে ঢাকা বিমানবন্দরে পাঠানো হলে ধরা পড়ে যান কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাছে।

সেখানে তাকে জেরা করতে থাকেন কর্মকর্তারা। পুলিশ আসে। পুলিশ তাকে জানায়, বাংলাদেশে হেরোইন পাচারের সর্বোচ্চ দন্ড মৃত্যুদন্ড। ভয় পান লিয়া। কাঁদতে থাকেন। পুলিশ তাকে নির্ভয় দেয়। হেরোইন পাচারের মূল মালিকের নাম বলে দিলেই এলিয়েদা বেঁচে যাবেন। কিন্তু তাকে তো ভালো করে চেনেনই না। পুরো ঘটনা খুলে বলেন এলিয়েদা। পরদিন যশোরের বেনাপোলে আটক হন মাদকের ডিলার রবার্ট বাংকসন টনি। সীমান্ত দিয়ে দেশত্যাগের চেষ্টা করছিলেন। পুলিশ ছিল অ্যালার্ট। তাকে ধরার জন্য রেড অ্যালার্ট জারি করেছিল পুলিশ আগেই। টনিকে লিয়ার সামনাসামনি করা হয়। লিয়া দেখিয়ে দেন এ ব্যক্তিটিই তার দেহে হেরোইন বেঁধে দিয়েছেন। টনি লিয়াকে চেনেন না বলে দাবি করেন। পুলিশের জেরার মুখে পরে অবশ্য স্বীকার করেন। বিচারে যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয় এলিয়েদার। তিনি ছিলেন প্রথম কোনো মার্কিন নাগরিক যাকে মাদক পাচারের অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ মামলার বিচার শেষ হয়। ১৯৯৩ সালের ৮ জুলাই রায় ঘোষণা করে আদালত। বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক আনসারউদ্দিন শিকদার তার রায়ে বলেন, এলিয়েদা মেকর্ড লিয়া পেশাদার মাদক পাচারকারী নন। তিনি ঘটনার শিকার মাত্র। মার্কিন এই তরুণীর জেল খাটতে হয়েছিল সাড়ে চার বছর। এক সকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর বিল রিচার্ডসন তার মুক্তির ফরমান নিয়ে হাজির ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেই জেলখানা থেকে সোজা বিমানবন্দর। লন্ডনগামী ফ্লাইটে চড়ে হিথ্রো বিমানবন্দর। সেখান থেকে ওয়াশিংটন ডিসি। ওয়াশিংটন থেকে টেক্সাস ডুলে বিমানবন্দর। নিজের বাসা। মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকা জেল থেকে উড়ে একদম নিজভূম টেক্সাস।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর