বৃহস্পতিবার, ৭ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

গ্রাহকের টাকায় বিলাসী জীবন কিউকম মালিকের

থাকতেন ১০ কোটি টাকার অভিজাত ফ্ল্যাটে

সাখাওয়াত কাওসার

গ্রাহকের টাকায়ই বিলাসী জীবন-যাপন করতেন ই-কমার্সের নামে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া কিউকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিপন মিয়া। কেবল রাজধানীর ধানমন্ডিতেই ছিল তার ১০ কোটি টাকার ৭ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট। হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যান মানিকগঞ্জের সাধারণ এক দলিল লেখক জসিম উদ্দীনের সন্তান রিপন। তার এমন অভিজাত জীবনের উৎস নিয়ে রীতিমতো ধাঁধায় পড়ে গেছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করে এই ফ্ল্যাটসহ অন্য কোথাও তিনি বিনিয়োগ করেছেন কি না তাও খতিয়ে দেখছেন তারা। তবে রিমান্ডে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে সেই ফ্ল্যাটটি তার শ্বশুর সিরাজগঞ্জ সদর পৌরসভার মেয়র সৈয়দ আবদুর রউফ মুক্তার বলে দাবি করেছেন রিপন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান এবং অতিরিক্ত কমিশনার এ  কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘কিউকমের প্রধান নির্বাহী রিপন দাবি করেছেন, তার আড়াই শ কোটি টাকার মতো দেনা রয়েছে। তিনি পেমেন্ট  গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানের কাছে ৪০০ কোটি টাকার মতো পাবেন। তার এই ভাষ্য আমরা খতিয়ে দেখছি। তিনি গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করে কী করেছিলেন তা জানা এবং গ্রাহকরা কীভাবে টাকা ফেরত পেতে পারেন সে বিষয়ে আমাদের অনুসন্ধান চলছে।’ সোমবার সকালে ধানমন্ডি এলাকা থেকেই কিউকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিপন মিয়াকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ওই দিনই তাকে আদালতে সোপর্দ করে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গ্রেফতারের আগের রাতে রাজধানীর পল্টন থানায় সৌরভ দে নামে এক গ্রাহক তার নিজেরসহ ১৫ জনের ৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে রিপন মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, মানিকগঞ্জ সদর থানার উকিয়ারার একজন  দলিল লেখক জসিম উদ্দীন। জীবনের বড় একটি সঞ্চয় দিয়ে ছেলে রিপনকে মালয়েশিয়ায় উচ্চশিক্ষা শেষ করিয়ে আনিয়েছেন। ২০১৯ সালে কিউকম সাইট চালু করেন রিপন মিয়া। গত বছর থেকেই শুরু হয় তার ই-কমার্স ব্যবসা। অবিশ্বাস্য ছাড়ে পণ্য দেওয়ার অফারের কারণে এক বছরেই প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধিত গ্রাহকের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ লাখে। এক বছরেই গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেন তিনি। বর্তমানে গ্রাহকরা তার কাছে আড়াই শ কোটি টাকার মতো পাওনা রয়েছেন বলে জানা গেছে। সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমরা  উত্থাপিত অভিযোগের বিপরীতে মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়গুলোও অনুসন্ধান করছি। আইনবহির্ভূত কর্মকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার বিরুদ্ধেই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।’ জিজ্ঞাসাবাদে রিপন মিয়া দাবি করেছেন, পেমেন্ট গেটওয়ে ফস্টারের কাছে টাকা আটকে না থাকলে তার এ সমস্যা হতো না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী গ্রাহক পণ্য হাতে পাওয়ার পর পেমেন্ট গেটওয়ে অর্থ তাদের কাছে স্থানান্তর করে। কিন্তু প্রতিদিন তাদের যে পরিমাণ পণ্য অর্ডার হয় এবং গ্রাহকের কাছে পৌঁছায়, এর বিপরীতে অনেক কম অর্থ তাদের কাছে আসছিল। এভাবে তার মূলধনের একটি বড় অংশ ফস্টারের কাছে আটকে যায়। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রিপনের দাবি অনুযায়ী তারা ফস্টারের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন। ফস্টার তাদের জানিয়েছে, কিউকমের ৩৯৭ কোটি টাকা তাদের কাছে রয়েছে। গ্রাহক পণ্য পেয়েছেন কি না তা নিশ্চিত করতে না পারায় তারা এ অর্থ স্থানান্তর করতে পারছে না। তবে প্রতারণা মামলা বা মানি লন্ডারিং মামলায় গ্রাহকদের টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা কম। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি গ্রাহকরা কীভাবে টাকা ফেরত পেতে পারেন সে বিষয়টি নিয়েও সরকারের জোরালো পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মন্তব্য তার। পুলিশ জানায়, সারা দেশে অন্তত এক ডজন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের কাছ থেকে পণ্য বিক্রির কথা বলে কয়েক হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই গ্রাহকদের সময়মতো পণ্য সরবরাহ না করে অর্থ আত্মসাৎ করেছে। এ অভিযোগে সম্প্রতি ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, রিং আইডি, নিরাপদ, টোয়েন্টিফোর টিকিটিসহ বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে একাধিক প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের। এর মধ্যে কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগও তদন্ত করা হচ্ছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, কিউকম গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ করে কী করেছে তা জানার চেষ্টা চলছে। তবে প্রাথমিকভাবে ধানমন্ডির ৬ নম্বর সড়কের ৩৭ নম্বর হোল্ডিংয়ে সাউথ ব্রিজ ভবনের দ্বিতীয় তলায় ৭ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। ওই ফ্ল্যাটেই স্ত্রী-পরিবার নিয়ে থাকতেন রিপন। ফ্ল্যাটটির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। রিপন দাবি করেছেন, ফ্ল্যাটটি তার শ্বশুরের। বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এদিকে সিআইডির একজন কর্মকর্তা জানান, ই-কমার্সের নামে যাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। গ্রাহকদের দায়ের করা মামলার পাশাপাশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগও তদন্ত করা হবে। ইতিমধ্যে কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান নানাভাবে গ্রাহকের অর্থের বড় একটি অংশ বিদেশে পাচার ও দেশেই অন্য প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করে ফেলেছে।

সর্বশেষ খবর