শনিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

দিনাজপুরে তৃতীয় লিঙ্গের মানবপল্লী

মাহবুব মমতাজী, দিনাজপুর থেকে ফিরে

দিনাজপুরে তৃতীয় লিঙ্গের মানবপল্লী

বাড়িতে সেদিন ছিল বিয়ের অনুষ্ঠান। উৎসবমুখর পরিবেশ। মেয়েদের গীত, শিশুদের হই-হল্লা, মুরব্বিদের হাঁক-ডাকে সরগরম ছিল গোটা বাড়ি। বধূর সাজে সাজছিল বোন। তার নয় বছর বয়সী অবুঝ ভাইটা তখন ছটফট করছিল ছাদে। বরপক্ষের কারও চোখে যাতে না পড়ে তাই তাকে ছাদেই বেঁধে রেখে যান মা-বাবা। অভাগা ভাই সবই বোঝে। মন কি তবু মানে! শিশু মনে অভিমান উথলে ওঠে। অশ্রুর বান ডাকে চোখে। কিন্তু তার কান্না চাপা পড়ে থাকে বিয়েবাড়ির উৎসবের আড়ালে। আর দশটা শিশুর মতো স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার হারিয়ে গুমরে মরে। নিজের ইচ্ছায় তো আর ‘হিজড়া’ হয়ে জন্মায়নি সে। তবুও জন্মই যেন তার আজন্ম পাপ! পদে পদে তার সীমাবদ্ধতা স্মরণ করিয়ে দেয় সমাজ। নিজের পরিবারেও সে যেন এক অনাহুত আগন্তুক! কিন্তু শিশু মনে কতটুকুই বা আর সয়! তাই একদিন নীরবে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়। বাড়ি ছাড়লেও জন্মের পাপ তাকে কোথাও তিষ্টাতে দেয় না। এখানে ওখানে ঠোক্কর খেতে খেতে পার হতে থাকে মানবেতর জীবন। অনিশ্চয়তার ঘোর অমানিশায় দিন যায়। মাস যায়, বছরের পর বছর যায়। একদিন তার ঠাঁই হয় দিনাজপুরের পুনর্ভবা নদীর তীরে, বিশেষ এক পল্লীতে। আট একর জায়গার চৌহদ্দীতে টিনের ছাউনি, কাঠের মেঝে। সারি সারি ঘর।

এখানেই ঠাঁই হয়েছে বাপ্পী নামে তৃতীয় লিঙ্গের একজনের। কথা হচ্ছিল তার পারিবারিক তিক্ত কাহিনি নিয়ে। সেখানে খোঁজ মেলে তার মতো প্রায় ৮০ জন হিজড়ার। আর কিছু সাধারণ মানুষ। দিনাজপুর সদরের বেংগিবেচা এলাকার বিশেষ ওই বসতিটার নাম মানবপল্লী।

বাংলাদেশে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে বিশেষ মর্যাদা পাওয়া হিজড়াদের জন্য এমন আবাসন তাবৎ বিশ্বেই বিরল নজির হয়ে উঠেছে। এখানে স্থান পাওয়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে চাঁদা তোলা ছেড়ে দিয়েছে। নবজাতককে জিম্মি করে আর টাকা আদায় করে না তারা। পেয়েছে প্রশিক্ষণ, অর্থ সহায়তা, স্বনির্ভর হওয়ার সুযোগ। নিজের আয়েই এখন জীবন ও জীবিকা চলে তাদের। অবসরে মেতে ওঠে নিজেদের মতো করে। ১৫ বছর আগে বাড়ি পালানো সেই শিশু এখন ২৪ বছরের বিশেষ মানুষ। তার মতো আর সবাই এখানে শান্তিতে ঘুমায়। দিনাজপুর সদর আসনের এমপি ও জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম ২০১২ সালে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় বিশেষ এ পল্লী গড়ে তোলেন। তারপর তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলোর পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসনে উদ্যোগী হন। তাদের হাতে তুলে দেন জমির দলিল। স্বনির্ভর করে তোলার জন্য বরাদ্দ দেন প্রয়োজনীয় অনুদান। কারিগরি শিক্ষা আর পশুপালনে আয়োজন করেন নিয়মিত প্রশিক্ষণ। মাছচাষের জন্য দেন পুকুর। অল্পদিনের মধ্যেই নিজেদের পরিবার থেকে নির্বাসিত মানুষগুলো একটা নতুন পরিবার হয়ে ওঠে। আর সফল এই উদ্যোগের জন্য সোশ্যাল ইনোভেটর ক্যাটাগরিতে আন্তর্জাতিক ওয়ার্ল্ড লিডারশিপ ফেডারেশনের ডব্লিউএলএফ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন এমপি ইকবালুর রহিম। জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভায় তাকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি প্রস্তাবও তোলা হয়। তবে স্থানীয় এমপির এই উদ্যোগে সবচেয়ে খুশি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো, যারা মানবপল্লীতে স্থান পেয়ে অবহেলা আর গ্লানির জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছে। জীবনযাপনের জন্য নিজেদের মতো পরিবেশ পেয়েছে। জীবিকা নির্বাহের নির্দেশনা ও উপায় খুঁজে পেয়েছে। নতুন করে বাঁচতে শিখেছে। নতুন জীবন পাওয়া এমনই আরও একজনের নাম পাপ্পু। দিনাজপুর জিলা স্কুলের মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। কিন্তু ছেলে হিসেবে জন্ম নিলেও ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে থাকে তার শরীরে। ধারণ করতে থাকেন মেয়েলি স্বভাব। এক সময়কার চেনা সহপাঠীরা অচেনা হয়ে উঠতে থাকে। উপহাস শুরু করে সমাজ। নিজের পরিবারেও প্রতিনিয়ত নিগৃহীত হতে থাকেন তিনি। তাই এইচএসসির পর আর পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে। নিজের সমাজচ্যুত হয়ে হিজড়াদের সঙ্গে ভিড়ে যেতে বাধ্য হন তিনি। সেদিনের সেই পাপ্পু এখন মানবপল্লীর সুন্দরী। হাসিখুশিতে মাতিয়ে রাখেন সবাইকে। ভালো নৃত্য করেন। নাচের অনুষ্ঠানই তার স্বাবলম্বী হওয়ার পথ খুঁজে দিয়েছে।

সরেজমিন ওই মানবপল্লীতে গিয়ে দেখা গেছে, মসজিদ-মন্দিরও স্থাপন করা হয়েছে। গড়া হয়েছে মাদরাসা, স্কুল। মানবপল্লীর বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের দুই বাসিন্দাকে চাকরি দেওয়া হয়েছে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয় ও দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। করোনা মহামারীর সময়টা বাদে প্রতি বছর দিনাজপুর বড় মাঠে যে বাণিজ্য মেলা বসে, সেখানে পার্টটাইম চাকরির সুযোগ আছে তাদের। মাছচাষের জন্য পুলিশ সুপার কার্যালয়ের পেছনে ১.৮ শতকের পুকুরটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাদের। দেওয়া হয়েছে গরু ও ছাগল। বছরজুড়েই দেওয়া হচ্ছে কাপড় সেলাই ও পোশাক তৈরি, হাঁস-মুরগি এবং গরু-ছাগল পালনের প্রশিক্ষণ। এসব প্রশিক্ষণ পেয়ে সমাজসেবা ও সমবায় অধিদফতর থেকে ঋণ নিয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন কেউ কেউ। জিআর ও টিআর এর চালও ভাগ্য খুলে দিচ্ছে কারও কারও। সাথী হিজড়া উন্নয়ন সংঘ নামে তাদেরই এক সংগঠন সেখানকার কর্মকান্ড তদারকি করছে। দিনাজপুরের এই মানবপল্লীর সফলতা সারা দেশের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে দেখাচ্ছে নতুন জীবনের স্বপ্ন। সমাজসেবা অধিদফতর সূত্র বলছে, বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে দেশের সাতটি জেলায় এ কর্মসূচি শুরু হয়। জেলাগুলো হচ্ছে- ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, পটুয়াখালী, খুলনা, বগুড়া এবং সিলেট। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে নতুন ১৪টি জেলায় কর্মসূচি সম্প্রসারণ করে মোট ২১টি জেলায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে হিজড়াদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া অর্থের পরিমাণ ৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর