সোমবার, ১১ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

বেরিয়ে আসে তিনটি মানুষের মাথা

মির্জা মেহেদী তমাল

বেরিয়ে আসে তিনটি মানুষের মাথা

ঢাকার মিন্টো রোডের গোয়েন্দা দফতর। থমথমে পরিবেশ। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মুখে হাসি থাকলেও টেনশন ভর করেছে তাদের মধ্যে। দেশের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ প্রভাবশালী ডন এখন তাদের কব্জায়। একটি রুমে বসিয়ে রাখা হয়েছে। একটু পরই জেরা শুরু হবে। গোয়েন্দারা তখনো দ্বিধা-দ্বন্দ্বে। এই বুঝি সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা আসবে। হয়তো ছেড়ে দিতে বলা হবে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা যোগাযোগ করছেন সদর দফতরে। তারা এই ডনের ব্যাপারে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ চায় না। কারণ, অনেক কাঠখড়ি পোড়াতে হয়েছে এই ভয়ংকর সন্ত্রাসীকে ধরার জন্য। জীবনবাজি রাখতে হয়েছে। এদিক থেকে সেদিক হলে, প্রাণ দিতে হতো পুলিশ গোয়েন্দাদের। এসব কিছু নিয়ে গোয়েন্দারা টেনশনে। অস্থির সময় পার করছেন তারা। এমন সময়ে পুলিশ সদর দফতর থেকে খবর আসল। বলা হলো, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো হস্তক্ষেপ করা হবে না। গোয়েন্দাদের তখন খুশির আর সীমা নেই।  ১৯৮২ সালের জানুয়ারির শীতের এক সকালে এক শ্বাসরুদ্ধকর

অভিযানের পর গ্রেফতার হয়েছিলেন তৎকালীন ভয়ংকর এক সন্ত্রাসী। পুলিশের তাড়া খেয়ে পালাচ্ছিলেন দুর্ধর্ষ গাল কাটা কামাল। এফডিসি থেকে বেরিয়ে ট্রাকস্ট্যান্ড হয়ে তেজগাঁও শিল্পএলাকায় যাওয়ার সময় পুলিশ তাকে ধাওয়া করে। একে একে ১১টি দেয়াল টপকেও শেষ রক্ষা হয়নি। ধরা তাকে পড়তেই হয়েছিল পুলিশের কাছে দুর্ধর্ষ এই ডনকে। মধ্যরাতে গোয়েন্দা দফতরে সেই গাল কাটা কামালকে জেরা শুরুর প্রস্তুতি চলছে। আর যিনি তাকে জেরা করবেন, তিনি হলেন গোয়েন্দা পুলিশের দুর্ধর্ষ অফিসার সহকারী কমিশনার (এসি) আকরাম হোসাইন। ছোট্ট কক্ষটিতে আলো আঁধারের আবেশ। মাঝে একটি চেয়ার। সেখানে বসা এসি আকরাম। তার পেছনে আরও তিন কর্মকর্তা দাঁড়ানো। আর তাদের সামনে ফ্লোরে বসা ভয়ংকর ডন কামাল। হাতে তার হ্যান্ডকাফ। চোখ বাঁধা। অনেক করেছিস। তোর দিন শেষ হয়ে গেছে। এবার তুই বলবি খুনের সব ইতিহাস। এসি আকরাম জানতে চান। মাথা নিচু করে থাকে কামাল। জবাব দেয় না। একবার হুংকার দিয়ে বলে, আমার পরিচয় কি জানেন না আপনারা? আমি কে, আমার পরিচয় কি, আমি কাদের লোক- এসব আগে জানুন। তারপর প্রশ্ন করুন। আপনার বিপদ হবে অফিসার! এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই মাথায় যেন রক্ত উঠে যায় একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার। তিনি এসি আকরামের পেছন থেকে লাফিয়ে সজোরে লাথি মারেন কামালের বুকে। আকস্মিক হামলায় কামাল ছিটকে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এরপরই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, তুই যা ভাবছিস, সব ভুল। কোনো মন্ত্রী, এমপি তোর সঙ্গে আর নেই। কেউ আসবে না তোর জন্য। তোর দিন শেষ হয়ে গেছে। চৌকশ পুলিশ অফিসার আকরাম হোসাইন ওই সময়ে সাত দিনের মধ্যে টিকাটুলী, গোপীবাগ ও সূত্রাপুর এলাকা থেকে নিখোঁজ যুবদল নেতা জাফর ও রানাকে হত্যার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। প্রথমে কামাল অস্বীকার করলেও পরে সব স্বীকার করতে বাধ্য হয়। খুনের পর কোথায় তাদের লাশ ফেলা হয়েছে তা জানতে চান আকরাম হোসাইন। এ ছাড়া সূত্রাপুরের ব্যবসায়ী তারই বন্ধু ফিরোজ আলম মামুনকে কেন খুন করা হয়েছে তাও জানতে চান।

দোর্দ- প্রতাপশালী গাল কাটা কামালের সামনে যখন একের পর এক হত্যাকান্ডগুলোর বিস্তারিত তুলে ধরছিলেন আকরাম হোসাইন, তখন গাল কাটা কামাল মাথা নিচু করে বসেছিলেন। কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছিলেন না।

তাকে আবারও জানানো হয়, এখন রক্ষা করতে কোনো মন্ত্রী- নেতা আসবেন না। পুরান ঢাকার সন্ত্রাসের মূর্তিমান আতংক গাল কাটা কামাল অনেকটা অসহায় হয়ে পড়ে। এরপর আস্তে আস্তে মুখ খুলতে শুরু করে। ভোররাতে তাকে নিয়ে বের হন টিকাটুলীর অভয় দাশ লেন ও শহীদ নবী উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। যেটাকে সে খুনখারাবির আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করত। এক সময় তার প্রিয় এই এলাকায় যখন হিংস্র বাঘের মতো দুই হাতে অস্ত্র উঁচিয়ে বাইক চালিয়ে মহড়া দিত। যার সঙ্গেই শত্রুতা থাকত, তাকে প্রকাশ্যে গুলি করত অথবা তুলে নিয়ে যেত। সেই সাম্রাজ্যেই হিংস্র দানবটির হাতে হ্যান্ডকাপ। যে কোমরে থাকত অস্ত্র সেই কোমরে বাঁধা মোটা রশি। পুলিশের গাড়ি থেকে নামানোর সময় অনেকের কাছেই বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই ছিল সন্ত্রাসী জীবনের উত্থান-পতনের বাস্তবতা।

যুবদল নেতা জাফর, রানাসহ আরও অনেককেই হত্যার পর শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে গানি ব্যাগে ভরে অভয় দাশ লেনের যে পুকুরটিতে ফেলে দিয়েছিল তা দেখিয়ে দেয় গাল কাটা কামাল। খবর দেওয়া হয় ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলকে। গাল কাটা কামালের অসহায়ত্তের দৃশ্যটি এক নজর দেখতে উৎসুক জনতা জড়ো হতে থাকে। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল গাল কাটা কামালের দেখানো জায়গাগুলোর পানির নিচে ডুব দিয়ে দিয়ে তল্লাশি চালাতে থাকে মানুষের কাটা মস্তকের সন্ধানে। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। একে একে ছোট ব্যাগ উদ্ধার করে নিয়ে আসছে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা। ভিতর থেকে বের করা হচ্ছে মানুষের কাটা মস্তক। এভাবেই তিনটি মস্তক উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে দুটি মাথা ছিল সপ্তাহ খানেক আগে খুন করা আবদুল খালেক রানা আর জাফরের। আরেকটি বেশি দিনের পুরনো মাথার কঙ্কাল। রাতেই ডিবি অফিসে জিজ্ঞাবাদে গাল কাটা কামাল তারই বন্ধু সূত্রাপুর থানা যুবদলের নেতা ফিরোজ আলম মামুনকেও খুনের কথা স্বীকার করেন। সূত্রাপুরে তার সঙ্গে থাকা জোড়া খুনে তার সঙ্গী আবুল কাশেম মানিক, মহিউদ্দিন আহম্মেদ ঝিন্টু ও শহীদ হোসেনসহ অর্ধডজন সহযোগীর নাম জানায়। আকরাম হোসাইন তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালান। বেশ কিছু অস্ত্র ও কয়েকজনকে আটক করা হয়। এর মাস দুই পরই দেশে সেনাশাসন জারি করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বিচারপতি সাত্তারের সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। দেশ শাসনের দায়িত্ব নেন সেনাপতি এরশাদ। গাল কাটা কামাল, দিলা, মোখলেস, ইমদুসহ অর্ধডজন কুখ্যাত খুনির সামরিক আদালতে বিচার শুরু হয়। ঢাকার ৯ নম্বর বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালে সূত্রাপুরের জোড়া খুনসহ একাধিক হত্যা মামলায় গাল কাটা কামাল, আবুল কাশেম মানিক, মহিউদ্দিন আহম্মেদ ঝিন্টু, শহীদ হোসেনের ফাঁসির আদেশ হয়। গাল কাটা কামাল গ্রেফতার থাকায় তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।

এই আসামির অনেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এদের একজন মহিউদ্দিন আহম্মেদ ঝিন্টু সুইডেন ২২ বছর রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকার পর থেকে ২০০৫ সালের ৩ জানুয়ারি  বিএনপির শাসনামলে সুইডেন থেকে মৃত্যুদন্ডের দন্ড মাথায় নিয়ে দেশে ফিরে আত্মসমর্পণ করেন। জানা গেছে, ওই সময় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আইনমন্ত্রী থাকাকালে সুইডেন সফরে গেলে তার থাকা-খাওয়া, আতিথেয়তা দেখভাল করেছিলেন মৃত্যুদন্ড পাওয়া আসামি মহিউদ্দিন আহম্মেদ ঝিন্টু। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের কাঁধে ভর করেই ফাঁসির দন্ড পাওয়া ঝিন্টুর প্রাণ ভিক্ষার ফাইল পৌঁছে যায় প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের কাছে। প্রেসিডেন্টের ক্ষমায় ঝিন্টু মাত্র ১০ দিন কারাভোগ করেই ১৩ জানুয়ারি ২০০৫ মুক্তি লাভ করেন। পুরান ঢাকার জামদানি দিলা ও মোখলেসও এরশাদ সরকারে প্রাণ ভিক্ষার অনুকম্পায় কারা জীবন থেকে মুক্তি লাভ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য গাল কাটা কামালের। আকরাম হোসাইনের জালে ধরা পড়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির দড়িতে ঝুলে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের মাধ্যমে তার জীবনাবসান ঘটে।

সর্বশেষ খবর