মঙ্গলবার, ১২ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

বাবাই ছিল খুনি

মির্জা মেহেদী তমাল

বাবাই ছিল খুনি

প্রধান আসামি বাবুল মিয়া নন, হবিগঞ্জের স্কুলছাত্রী বিউটি বেগমকে হত্যা করেছেন তার পড়শি চাচা ময়না মিয়া। আর সহযোগিতায় ছিলেন বাবা ছায়েদ আলী নিজেই। হত্যাকান্ডে ছিল ১০ হাজার টাকার ভাড়াটে এক খুনিও। বিউটিকে বাবুল মিয়া ধর্ষণ করলেও হত্যাকান্ডে সরাসরি সম্পৃক্ততা নেই তার। আদালতে ছায়েদ আলী ও ময়না মিয়ার দেওয়া জবানবন্দি ছিল এমনই। ২০১৮ সালের ১৭ মার্চ সকালে জেলার শায়েস্তাগঞ্জের পুরাইকলা বাজারসংলগ্ন হাওর থেকে বিউটির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় সেদিনই বিউটিকে হত্যা ও ধর্ষণের অভিযোগে তার বাবা ছায়েদ আলী বাদী হয়ে বাবুল (৩২) ও তার মা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য কলমচাঁন বিবির (৪৫) নামোল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে শায়েস্তাগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিউটির নিথর মরদেহের ছবি ছড়িয়ে পড়ার পর এ নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। হত্যা ও ধর্ষণে জড়িতদের বিচার দাবিতে দেশজুড়ে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। ২১ মার্চ কলমচাঁন ও বাবুলের বন্ধু একই গ্রামের ইসমাইলকে আটক করে পুলিশ। এরপর ৩১ মার্চ সিলেটের বিয়ানীবাজার থেকে গ্রেফতার করা হয় বাবুলকে। ৬ এপ্রিল হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বাবুল বিউটি হত্যা ও ধর্ষণের দায় স্বীকার করেন। এর মধ্যে ৫ এপ্রিল গ্রেফতার করা হয় বিউটির চাচা ময়নাকে, ৬ এপ্রিল ধরা হয় ছায়েদকে। বিউটির বাবা ও মামলার বাদী ছায়েদ আলী পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী জবানবন্দিতে অকপটে স্বীকার

করে নেন মেয়ে হত্যার পেছনে তার জড়িত থাকার কথা। হত্যাকান্ডের রাতে নিজেই নানার বাড়ি থেকে এনে বিউটিকে তিনি তুলে দেন খুনিদের হাতে। ১৬ মার্চ রাত সাড়ে ১০টায় লাখাই উপজেলার গণিপুরের নানির বাড়ি থেকে বিউটিকে নিয়ে যান ময়না, ছায়েদ ও তাদের ভাড়াটে খুনি। রাত ১২টায় ঘটে হত্যাকান্ড। বটতলা এলাকায় বিউটিকে ধরে রাখে ভাড়াটে খুনি, ছুরি দিয়ে পাঁচবার আঘাত করেন ময়না। ২০ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন ছায়েদ। হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি উদ্ধার করে পুলিশ। মামলার প্রধান আসামি বাবুল ‘সরাসরি হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত নন’ বলে  নিশ্চিত হয় পুলিশ। তবে পুলিশ এটি নিশ্চিত যে, বিউটিকে একটি ভাড়া বাড়িতে রেখে টানা ১৭ দিন ধর্ষণ করেছেন বাবুল। হত্যায় তার সম্পৃক্ততা নেই।

বাবুল মিয়া শায়েস্তাগঞ্জের ওলিপুরে একটি কোম্পানিতে চাকরি করছিলেন। তার মা কলমচাঁন ইউপি নির্বাচনে সংরক্ষিত মহিলা সদস্য নির্বাচিত হন। আর্থিকভাবে প্রভাবশালী বাবুল এর আগে এক প্রবাসীর স্ত্রীকে বিয়ে করে ফেলেন। এর মধ্যে তার নজর পড়ে স্কুলছাত্রী বিউটির ওপর। তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে বিয়ের প্রলোভন দেখান এবং নিজের কোম্পানিতে চাকরির আশ্বাস দেন। এর ধারাবাহিকতায় ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত বাবুল ওলিপুর এলাকায় ১ হাজার টাকায় একটি রুম ভাড়া নিয়ে বিউটিকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে একসঙ্গে থাকেন। ৯ মার্চ বিউটিকে নিয়ে যান সেই কোম্পানিতে। একই কোম্পানিতে কাজ করেন বিউটির মা হুসনা বেগমও। বিষয়টি জেনে তিনি মেয়েকে বাড়ি নিয়ে আসেন।

এরপর এ নিয়ে দুই দফায় গ্রাম্য সালিশ ডাকা হলেও বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে যায়। বিউটিকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানান বাবুলও। পরে স্কুলছাত্রীটিকে হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে তিন দিন রাখা হয়। ১৪ মার্চ  হবিগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে বিউটিকে অপহরণসহ ধর্ষণের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। পরে মামলাটি শায়েস্তাগঞ্জ থানায় এফআইআর করা হয়। এর মধ্যে ১২ মার্চ বিউটিকে থানায় নেওয়া হয়। মেডিকেল পরীক্ষার পর সে আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দি দেয়। এমনকি বাবুল তাকে বিয়ে করলে মামলা তুলে নেবে বলেও জানায়। কিন্তু বিউটিকে বাড়িতে আনার পর দিশাহারা হয়ে পড়েন ছায়েদ। এক পর্যায়ে তাকে পাঠিয়ে দেন নিকটস্থ লাখাইয়ের গুণিপুর গ্রামে তার নানি ফাতেমা বেগমের বাড়িতে। হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা হয় তখন থেকেই। ইউপি নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড থেকে সংরক্ষিত নারী আসনের মেম্বার পদে নির্বাচন করেন ময়নার স্ত্রী আসমা আক্তার ও বাবুলের মা কলমচাঁন। কথা ছিল কলমচাঁন নির্বাচনে না গিয়ে আসমাকে ছাড় দেবেন। কিন্তু কথা না রেখে কলমচাঁন ভোট করে আসমাকে হারিয়ে দেন। এরপর উভয় পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ছায়েদ আলী প্রথম মামলাটি করলে এতে সাক্ষী হন তার ঘনিষ্ঠ ও এলাকার আদম ব্যবসায়ী ময়না। বিউটিকে নানার বাড়িতে পাঠানোর পর এই ময়না প্রায়ই ছায়েদকে বোঝাতে থাকেন, বিউটিকে বাবুল বিয়ে না করলে তাকে আর কেউ বিয়ে করবে না। অন্য সন্তানদেরও আর বিয়ে হবে না। এরপর বিউটিকে মেরে বাবুল ও তার মাকে ফাঁসানোর ছক বোঝান ছায়েদকে।

এক পর্যায়ে ময়নার ফাঁদে পা দেন ছায়েদ আলী। তাকে নানির বাড়ি থেকে বের করার সময় চেয়ারম্যানের কাছে নেওয়ার কথা বলা হয়। পরে লাখাইয়ের সেই বটলতায় ঘটে হত্যাকান্ড। বিউটিকে খুনের পর রক্ত ধুয়ে মরদেহটি হাওরে ফেলে রাখা হয়। মরদেহ উদ্ধারের খবরে নানি বিউটিদের বাড়িতে এলে তাকে শাসিয়ে দেওয়া হয় কোনো কিছু না বলার জন্য।

যদিও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ‘বিউটিকে রাতে কে নিয়ে গেছে, কীভাবে নিয়ে গেছে এবং তাকে কী বলে নিয়ে গেছে’ সেসব বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দেন ফাতেমা। মেয়ে হত্যার পর একজন বাবার যে অনুভূতি থাকার কথা ছিল তা ছায়েদের চেহারায় ছিল না। তার ও ময়নার চলাচল এবং আচরণে সন্দেহ হলে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে তথ্য ঘেঁটে বের করে দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর