শুক্রবার, ২২ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

বিশৃঙ্খল সড়কে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল

জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস আজ

শিমুল মাহমুদ

দেশের সড়ক-মহাসড়কে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কারণে নিয়মিত বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগের পরও দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার কমানো যাচ্ছে না। উপরন্তু দেশে মোটরসাইকেলের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনায় বড় ভূমিকা রাখছে এ দ্বিচক্রযানটি। গত কয়েক বছরের দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, বর্তমানে দুর্ঘটনায় মৃতের অন্তত ৩৫ শতাংশই হচ্ছে মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী। অন্যদিকে মহাসড়কে চলাচলকারী স্বল্পগতির থ্রিহুইলার, রিকশা, ভ্যান, বিপজ্জনক নসিমন-করিমনের কারণে দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। মহাসড়কে পৃথক লেন না থাকায় বেপরোয়া গতির বাস-ট্রাকের সামনে পড়ে ছোট যানবাহনের চালক-আরোহীরা করুণ মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন। এ প্রেক্ষাপটে ‘গতিসীমা মেনে চলি সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করি’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে দেশে আজ পঞ্চমবারের মতো জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সেমিনার, আলোচনা সভা, পদযাত্রা, সড়ক আইন সম্পর্কিত সচেতনতামূলক লিফলেট, স্টিকার বিতরণসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গতকাল এক বাণীতে সড়ক নিরাপত্তা কার্যক্রম টেকসই করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে উন্নত সড়ক অবকাঠামো বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সড়কপথে মোটরযানের সংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত গতি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। তাই জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি রোধকল্পে গতিসীমা মেনে চলা আবশ্যক।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল এক বাণীতে বলেছেন, বেপরোয়া গতিতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে মোটরযান চালনা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, সড়ককে নিরাপদ করতে এবং দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের সরকার সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন ও আধুনিকায়নসহ নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।

ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের রোড সেইফটি প্রকল্পের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়- মহাসড়কে গাড়ির গতি কমিয়ে অন্তত ৩০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব। মিশনের সহকারী পরিচালক মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, পাঁচটি রিস্ক ফ্যাক্টরের সমাধান করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব। তিনি বলেন, ড্রাইভারসহ যাত্রীর সিটবেল্ট পরিধান বাধ্যতামূলক করা হলে সামনের সিটের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ এবং পেছনের সিটের ক্ষেত্রে ৭৫ শতাংশ যাত্রীর দুর্ঘটনায় আহত হওয়া রোধ করা সম্ভব। মোটরসাইকেলের আরোহীদের যথাযথ ও মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০ শতাংশ মৃত্যু কমানো ও ৭০ শতাংশ গুরুতর আহত হওয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব। গাড়ির গতি গড়ে ৫ শতাংশ কমানো গেলে ৩০ শতাংশ দুর্ঘটনা হ্রাস করা সম্ভব। পরিবহনে বিশেষ করে ছোট গাড়িতে শিশুদের উপযুক্ত আসন ব্যবস্থা রাখলে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৪ থেকে ৮০ শতাংশ শিশুকে নিরাপদ রাখা সম্ভব। মদ্যপান ও নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনের ক্ষেত্রে সড়ক আইনের সংশোধন ও এর যথাযথ বাস্তবায়ন করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ২০ শতাংশ কমানো সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতের জন্য যানবাহনের চালক, যাত্রী ও পথচারীর সচেতনতার পাশাপাশি সুশৃঙ্খল সড়ক পরিবেশ খুবই প্রয়োজন। বর্তমান সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলোকে চার ও ছয় লেনে উন্নীত করছে। কিন্তু সড়কে মিশ্রগতির যানবাহনের কারণে দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যাচ্ছে না। দেশের ২২টি মহাসড়কে বিপজ্জনক থ্রিহুইলার, ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান বন্ধে একাধিকবার পদক্ষেপ নিয়েও কার্যকর করতে পারেনি সরকার। এসব প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সড়কে গাড়ির সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ ও তা মনিটর করা, মোটরসাইকেল আরোহীর ক্ষেত্রে মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা, ব্যক্তিগত যানবাহনে চালকসহ যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা বাধ্যতামূলক করা, মহাসড়কে মিশ্রগতির যানবাহনের চলাচল বন্ধ ও পৃথক লেনের ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়ে নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়ন করা সম্ভব। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়- গত কয়েক বছরে সড়ক নিরাপত্তায় দেশের উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। এর মধ্যে ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জনের মৃত্যু এবং ১৫ হাজার ৪৬৬ জন আহত হন। ২০১৯ সালে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৮৫৫ জন এবং আহত হয়েছেন ১৩ হাজার ৩৩০ জন। ২০২০ সালের মার্চ থেকে করোনা সংক্রমণের কারণে বছরের অধিকাংশ সময়ই সড়কপথ ছিল লকডাউন-কবলিত। তার পরও ২০২০ সালে দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আহত হন ৮ হাজার ৬০০ জন।

দেশে নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে কাজ করছেন ইলিয়াস কাঞ্চন। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের চেয়ারম্যান এই অভিনয়শিল্পী সড়ক দুর্ঘটনার পেছনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন সড়কের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের অভাব, টাস্কফোর্সের ১১১টি সুপারিশনামা বাস্তবায়ন না হওয়া, চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রবণতা, চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানো, লাইসেন্স ছাড়া চালক নিয়োগ, পথচারীদের সচেতনতার অভাব, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো, সড়ক ও মহাসড়কে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার গাড়ি বৃদ্ধি, মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, একই রাস্তায় দ্রুত ও শ্লথ গতির যানবাহন চলাচল এবং রাস্তার পাশে হাটবাজার ও দোকানপাট থাকা। সড়ক পরিবহন আইনের সঠিক বাস্তবায়ন হলে সড়ক নিরাপদ হয়ে উঠবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর