সোমবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

গরুর অভাবে ঘানি টেনে দম্পতির জীবন-জীবিকা

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি

গরুর অভাবে ঘানি টেনে দম্পতির জীবন-জীবিকা

সাধারণত ঘানি টানার জন্য গরু ব্যবহার করা হয়। তবে দরিদ্র খর্গ মোহন সেনের গরু কেনার সামর্থ্য নেই। অভাবের সংসার। এক দিন ঘানি না টানলে সংসারের চাকা ঘোরে না। ১ কেজি ২৫০ গ্রাম তেল উৎপাদনে দম্পতির ঘানির জোয়ালে হাঁটতে হয় ৮ থেকে ৯ কিলোমিটার। স্বামী-স্ত্রী মিলে কাঠের তৈরি কাতলার ওপর প্রায় ৪৫০ কেজি ওজন বসিয়ে ঘাড়ে জোয়াল নিয়ে ঘানি টানছেন দীর্ঘ ৪০ বছর।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের গুয়াবাড়ি কিসামত এলাকার খর্গ মোহন সেন ও তার স্ত্রী রিনা রানী সেন। তাদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ভিটাবাড়িটুকুই সম্বল। মানুষকে নির্ভেজাল তেল খাওয়াবেন বলে বংশপরম্পরায় এ পেশা তারা ছাড়ছেন না। তাদের বংশের সবাই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। গ্রামের মানুষ এ পেশা ছেড়ে দিতে বলেন এবং মাঝে মধ্যেই কটু কথাও বলেন।

সবকিছু সহ্য করে বাপ-দাদার পেশা আগলে ধরে রেখেছেন। মেশিনের তৈরি সরিষার তেলের দাম বাজারে কম। ঘানি ভাঙা তেলের দাম বেশি। সাধারণ মানুষ বেশি দামে ঘানির তেল কিনতে চায় না। যারা ভেজালমুক্ত ঘানি ভাঙা খাঁটি সরিষার তেল কেনেন, সংখ্যায় তারা খুবই কম। খর্গ মোহন সেনের বয়স প্রায় ৬০ বছর, তার স্ত্রী রিনা রানীর বয়স ৫৫ বছর। একসময় তারা ঘানি ভাঙা ৬ থেকে ৭ কেজি তেল উৎপাদন করতে পারতেন। বয়সের কারণে আগের মতো শরীরের শক্তি নেই। হতদরিদ্র স্বামী-স্ত্রী এখন মাঝে মধ্যে নিজেরাই ঘাড়ে জোয়াল নিয়ে ঘানি টানেন। ১ থেকে ২ কেজি তেল উৎপাদন করতে পারলে বিক্রি করে কোনোরকমে সংসার চলে। বয়সের ভারে মাঝে মধ্যে শরীর ভালো থাকে না। সে সময়টা দরিদ্র পিতা-মাতাকে সন্তানের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় একমুঠো ভাতের জন্য। সরেজমিন গুয়াবাড়ি কিসামত গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িটিতে একটি ঘানিগাছ রয়েছে। তাতে তেল উৎপাদন হচ্ছে। খর্গ মোহন সেন বাড়ির বারান্দায় বসে তেল মেপে দিচ্ছেন কামরুল হাসান নামের এক যুবককে। পাশের একটি ছোট্ট ভাঙা ঘরে ঘানি টানছেন রিনা রানী। ঘানির ডালায় দেশি পাঁচ কেজি সরিষা দিয়ে প্রায় চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা যাবৎ ঘানি টেনে ১ কেজি ২৫০ গ্রাম পরিমাণ তেল উৎপাদন করেছেন। এতে খৈল হয়েছে প্রায় তিন কেজি। দেশি সরিষার দাম এখন বেশি হওয়ায় প্রতি কেজি তেল বিক্রি করেন ৪০০ টাকা। আর খৈল বিক্রি করেন ৭০ টাকা কেজি দরে। রিনা রানী সেন জানান, টাকার অভাবে গরু কিনতে পারি না, স্বামী-স্ত্রী নিয়ে এক জোয়াল টানি, এক দিন জোয়াল টানতে না পারলে খাব কী? বয়স হচ্ছে, আগের মতো পারি না, দুটি না হলেও একটি গরু থাকলেও এমন হাড়ভাঙা পরিশ্রম স্বামী-স্ত্রীকে করতে হতো না। মাঝে মধ্যে আমার বড় ছেলে ঘানি টেনে সহযোগিতা করে। খর্গ মোহন বলেন, আগের মতো দেশি সরিষা পাওয়া যায় না। গ্রামে ঘুরে ঘুরে সরিষা সংগ্রহ করি, তারপরও দাম বেশি। বাপ-দাদার সঙ্গে জোয়াল (ঘানি) টানতে টানতে অন্য কোনো কাজ শিখতে পারিনি। প্রায় পাঁচ যুগ ধরে নিজে জোয়াল টানছি। এখন আর শরীর চলে না, স্ত্রীর সঙ্গে বড় ছেলে জোয়াল টানে। একটি গরু থাকলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বংশপরম্পরায় পেশাটি ধরে রাখতে পারতাম। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মো. সামসুজ্জামান বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। বর্তমান সময় ঘানি ভাঙা সরিষার তেল বিলুপ্তির পথে। তাই ঘানিতে সরিষার তেল উৎপাদন করার জন্য খর্গ মোহনকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে।

 

সর্বশেষ খবর