বুধবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

ব্যাংকের চেকে খুনির পরিচয়

মির্জা মেহেদী তমাল

ব্যাংকের চেকে খুনির পরিচয়

ঝানু গোয়েন্দা কর্মকর্তা কাইয়ুম বক্স। তার মতো চৌকস কর্মকর্তা ডিপার্টমেন্টে আছেন হাতে গোনা কয়েকজন। ক্লু-লেস ভয়ংকর অপরাধের রহস্য উন্মোচন করে হইচই ফেলে দিয়েছেন এমন অসংখ্য রেকর্ড আছে তার চাকরি জীবনে। যে কারণে কোনো ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হলে ডাক পড়ে কাইয়ুম বক্সের। এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ও সূক্ষ্ম বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে ধীরে ধীরে উন্মোচন করেন রহস্যের কঠিন জাল।

চৌকস এই গোয়েন্দাকেও ভাবিয়ে তোলে একটি নিখোঁজ ঘটনা। বুঝতেই পারছেন না কোন পথে এগোবেন তিনি। ঘটনার তিন মাস পর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। পাশাপাশি সরকারের একটি কঠোর বার্তাও পান তিনি। তাতে বলা হয়েছে- ‘যে করেই হোক নিখোঁজকে খুঁজে বের করতে হবে। অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এর বাইরে কোনো কথা চলবে না।’ সরকারের এমন কঠোর বার্তা কাইয়ুম বক্সকে গভীর চিন্তায় ফেলে দেয়। কী করবেন তিনি? ২৭ জানুয়ারি, ১৯৭৬। বাসা থেকে বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে চেপে ক্লাস করতে ক্যাম্পাসে যান নীহার বানু। সন্ধ্যা নামার পরও মেয়েটি বাসায় ফিরে না আসায় বিধবা মায়ের মনে দুশ্চিন্তা। মা আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন। ভাবেন বড় মেয়েটি বাসায় ফিরে এলেই খুঁজতে বের হবেন। পেশায় চিকিৎসক বড় মেয়ে বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর থেকেই সংসারটা টেনে নিয়ে চলছেন। সন্ধ্যা কেটে রাতের আঁধার, মেয়ে তখনো ফেরেননি। অজানা আশঙ্কা। আর স্থির থাকতে পারেন না। ঘরের সদর দরজা খুলে গভীর উদ্বেগ নিয়ে বড় রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকেন মা। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেডিকেল কলেজ থেকে ডিউটি শেষে বাড়ি ফেরেন বড় মেয়ে। মেয়েকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সুযোগ না দিয়েই উৎকণ্ঠিত মা বলছিলেন, ‘নীহার তো এখনো ফিরল না রে!’ শুনে অবাক হয়ে বড় মেয়ে বলেন, ‘এখনো ফেরেনি! বল কি মা!’ এর পরও চলে খোঁজাখুঁজি। কিন্তু পাওয়া যায়নি নীহারকে। পরদিন আশা-নিরাশার দোলাচলে পরিবারের সদস্যরা যান বিশ্ববিদ্যালয়ে, ক্লাসে, মেয়েদের হলে; কথা হয় বিভাগের চেয়ারম্যান ও শিক্ষকদের সঙ্গে।

খোঁজাখুঁজির সংক্ষিপ্তসার হলো- আগের দিন সকালে নীহার বাসে বিশ্ববিদ্যালয় গিয়েছেন কিন্তু বিকালে বাসে ফেরেননি। সহপাঠীরা বললেন, নীহার ক্লাসে ছিলেন, হাজিরা খাতা দেখে শিক্ষকরা তার ক্লাসে উপস্থিতি নিশ্চিত করলেন। কেউ কেউ বললেন, ক্লাস শেষে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিংয়ের পাশে এক সহপাঠী ছাত্রের সঙ্গে তাকে কথা বলতে দেখা গেছে। কেউ কেউ বললেন, দুপুরের দিকে তাকে রিকশায় শহরের দিকে যেতে দেখা গেছে। এই ছিল তার সম্পর্কে সর্বশেষ খবর।

নীহার বানুর খোঁজ মেলে না। তার নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন পর আরেক শিক্ষার্থী আহমেদ হোসেন বাবু লাপাত্তা! তবে ছাত্রটি নিখোঁজ নন। বলা যায় আত্মগোপন। তার বন্ধুদের কেউ কেউ বলেছেন, ব্যাংকে চাকরি নিয়ে ঢাকায় গেছেন বাবু। কিন্তু সেই বাবুকে আর কোনো দিন ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি। বাবু ছিলেন নীহার বানুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সন্দেহের তীর তার দিকেই। নীহার বানু নিখোঁজের তিন মাস পর নতুন করে তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির দক্ষ গোয়েন্দা কাইয়ুম বক্স। নীহার বানুর নিখোঁজ আর তার বন্ধু বাবুর লাপাত্তার বিষয়টি মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েছেন কাইয়ুম বক্স। নীহার বানু নিখোঁজ রহস্যের জাল ভেদ করতে কোন পথে এগোবেন? নিজের কাছে প্রশ্ন রাখেন গোয়েন্দা কাইয়ুম। কিন্তু ঘটনার তিন মাস পর তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ায় পরিষ্কার কোনো জবাব খুঁজে পান না। অর্থাৎ গোয়েন্দা কাইয়ুম ঘটনার কোনো সূত্র খুঁজে পান না। তিনি ক্লু খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।

দুই দিন পর ছদ্মবেশ নেন কাইয়ুম। ক্যাম্পাস, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসসহ আশপাশ এলাকায় ঘোরাঘুরি করেন দিনের পর দিন। কখনো বাদাম বিক্রেতা, কখনো ঝালমুড়ি বিক্রেতা। ক্যাম্পাসজুড়ে বিকিকিনি তার। কোনো লাভ হয় না। দিন যায়, সপ্তাহ ঘুরে মাস যায়। কিন্তু কাইয়ুমের তদন্তেও নেই কোনো আশার আলো। জড়িতদের গ্রেফতার দাবিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনে উত্তপ্ত। সেদিন সকাল থেকেই কাইয়ুম বক্সের শরীর খারাপ। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। তার মাথায় শুধু এক চিন্তা। নীহার বানুকে কারা নিখোঁজ করল? এমন চিন্তা যখন তার মাথায় তখন বাবুর নামটি বারবার তার সামনে চলে আসছে। কাইয়ুম বক্সের হঠাৎ মনে পড়ে তার এক সিনিয়র অফিসারের কথা। তিনি তাকে বলেছিলেন কেউ যদি পালিয়ে যায় বা আত্মগোপন করে তবে তার হাতখরচ বেড়ে যায়। টাকার দরকার হয়। অ্যাকাউন্ট থাকলে সেখান থেকে টাকা তুলবেই। এমন সব ভাবতেই হঠাৎ কী মনে করে হুড়মুড় করে শোয়া থেকে উঠে বসেন। দেয়ালঘড়িটায় চোখ রেখেই বিড়বিড় করে বললেন, হ্যাঁ সময় আছে এখনো। কাইয়ুম বক্স দ্রুত নিজ বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন। সোজা চলে যান বিশ্ববিদ্যালয় শাখা অগ্রণী ব্যাংকে। সেখানে বাবুর অ্যাকাউন্ট খোঁজ করা হয়। হ্যাঁ, খুঁজে পাওয়া গেছে। বাবুর সেভিংস অ্যাকাউন্ট নম্বর ৩৮২৮। ব্যাংক থেকে পুলিশ বাবুর লেনদেনের একটি কপি সংগ্রহ করে। তার অ্যাকাউন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২৮ জানুয়ারি শহীদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি চেক দিয়ে ১ হাজার ৬০০ টাকা তুলে নিয়েছেন। কাইয়ুমের মনে খটকা লাগে। নীহার বানু নিখোঁজ হলেন ২৭ জানুয়ারি। পরদিন শহীদুল ইসলামের নামে কেন চেক লিখে দেবেন বাবু? শহীদুল ইসলাম কে? শহীদুল ইসলামের খোঁজ করে জানতে পারেন গোয়েন্দারা, তিনি বাবুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পুলিশ ৩১ মে শহীদুল ইসলামকে গ্রেফতার করে। শহীদকে জেরা করা হয়। পুলিশ তার কাছ থেকে বাবুর অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানতে পারল না। কিন্তু যা জানা গেছে তা শুনে হতবাক সবাই। পুলিশ তার কাছ থেকে বাবুর আরেক বন্ধু এনামুলের বাড়ির ঠিকানা নেয়। পুলিশ বগুড়ায় গিয়ে এনামুলকে গ্রেফতার করে।

শহীদ আর এনামুল পুলিশের কাছে সব তথ্য ফাঁস করে দেন। নিখোঁজ হওয়া সেই নীহার বানু আর নেই! কোনো ধরনের সন্দেহ এড়াতে আবারও প্রশ্ন রাখে পুলিশ। একই জবাব আসে যুবক দুটির কাছ থেকে। ফাঁস হয় সেই রোমহর্ষক ঘটনা। তারা দেখিয়ে দেন কোথায় আছেন নীহার বানু। ওই বছরের ১২ জুন একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মাটি খুঁড়ে ফেলা হয়। প্রায় ছয় মাস পর সেখান থেকে কঙ্কাল উদ্ধার হয়। তবে সেখানে ঠিকই ছিল পরনের তাঁতের শাড়ি, হলুদ রঙের ব্লাউজ, নীল রঙের কার্ডিগান, পায়ে ছিল হাইহিল বাটার জুতা। গলায় একটি চার কোনা তাবিজ। পুলিশ জানতে পারে বাবু আর নীহার বানু ছিলেন ধর্মের ভাইবোন। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে বাবু বলে বেড়াতেন নীহার বানুকে তিনি ভালোবাসেন। বিয়েও করবেন। এমন কথা শুনে নীহার বানুর রাগ হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাস শেষে একদিন বাবুর সঙ্গে কথা বলছিলেন নীহার। ‘বাবু ভাই, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আগামী মাসেই বিয়ে।’ আকাশ থেকে পড়েন বাবু। বলেন, ‘বিয়ে ঠিক হয়েছে! বল কী! আমাকে বলছ কেন?’ নীহার বলেন, ‘তুমি আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন। তোমাকেই তো আগে বলব বাবু ভাই।’

বিয়ের কথা শুনে বাবু যেন পাগল হয়ে যান। নীহারকে বিদায় দেন। বন্ধুদের আড্ডা শুরু। বাবু বলেন, ‘আমি নীহারকে ভালোবাসি। ওকে ছাড়া বাঁচব না। আমি না পেলে আর কাউকে পেতে দেব না।’ বন্ধুরা জানতে চান কী করতে হবে। বাবু বলেন, ‘২৭ জানুয়ারি নীহার বানুকে বিয়ে করব। নীহার রাজি না হলে খুন করে ফেলব।’

১৯৭৬ সালের ২৭ জানুয়ারি ক্লাস শেষে বাবু বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে শহরের মীনা মঞ্জিল নামের একটি বাড়িতে নিয়ে যান নীহার বানুকে। আত্মীয়ের বাসা বলে নিয়ে যান নীহারকে। ওই বাসার ভিতরে গিয়েই নীহার দেখতে পান আরও চার-পাঁচ যুবক সেখানে বসা। বাসার দরজা-জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখনো কিছু বুঝতে পারেননি নীহার। বাবু সরাসরি প্রশ্ন রাখেন, ‘নীহার, আমি তোমাকে বিয়ে করব। বল আমাকে বিয়ে করবে কি না?’ নীহার বানু অবাক হয়ে বলেন, ‘কী বলেন বাবু ভাই! আমি আপনাকে বিয়ে করব না। আমাদের মধ্যে ভাইবোনের সম্পর্ক।’ ক্ষুব্ধ হন বাবু। নীহারের শাড়ি দিয়েই নীহারের গলা পেঁচিয়ে ধরেন। দম বন্ধ হয় নীহারের। হাত-পা ছুড়তে থাকেন। পাঁচ-ছয় ব্যক্তির সঙ্গে কীভাবে পারবেন নীহার! বাঁচার চেষ্টা করেও পারলেন না। লাশ সেখানেই রেখে বাবুসহ সবাই চলে যান। দরজায় লাগানো হয় তালা। সন্ধ্যায় আবার সবাই ফিরে আসেন। তালা খুলে ভিতরে ঢোকে। এরপর লাশ গুমের পরিকল্পনা। বাবু বাজার থেকে তার বন্ধু শহীদুলকে ট্রাঙ্ক কিনে আনতে বলেন। ট্রাঙ্ক রাতে নিয়ে আসা হয়। ততক্ষণে নীহারের লাশ শক্ত হয়ে গেছে। ট্রাঙ্কে ঢোকানো গেল না। ট্রাঙ্ক ফেরত দিয়ে উঠানের এক কোনায় মাটি খোঁড়া হয়। সেখানেই মাটিচাপা দেওয়া হয় নীহারকে। কিন্তু বাবু আরও সতর্কতার জন্য মাটির ওপর সিমেন্টের প্লাস্টার করে দেন।

দেশে তখন সামরিক শাসন। বগুড়ায় স্থাপিত দেশের উত্তরাঞ্চলের ৭ নম্বর বিশেষ সামরিক আইন আদালতে বিচার শুরু হলো। ২৯ আগস্ট মামলার রায় ঘোষণা হবে। এ রায় শুনতে শত শত মানুষ সেদিন হাজির হয়েছিল আদালত প্রাঙ্গণে। পুশিকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। আদালতে হাজির করা হয় চার আসামিকে। তবে আসল দুই আসামি বাবু আর আহসানুল পলাতক সেই সময় থেকেই। বিকাল ৫টায় আদালতে বিচারক আসেন। ৫টা ২ মিনিটে রায় পড়তে শুরু করেন বিচারক। আদালত বাবু, আহসানুল এবং শহীদুলের ফাঁসির আদেশ দেয়। এর মধ্যে বাবু আর আহসানুল পলাতক। শহীদুলের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। আর সহযোগিতা করায় মীনা মঞ্জিলের কেয়ারটেকার ফেতুকে পাঁচ বছরের জেল দেয় আদালত।

সর্বশেষ খবর