শুক্রবার, ৫ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ছদ্মবেশ নিয়ে খুনি ধরল পুলিশ

মির্জা মেহেদী তমাল

ছদ্মবেশ নিয়ে খুনি ধরল পুলিশ

বাসার সামনেই খেলছিল শিশুটি। হঠাৎ শিশুটি নেই। একদম উধাও। প্রথমে টের পাননি শিশুটির মা। শিশুটি উধাও হয়ে যাবে চোখের পলকেই- এমন চিন্তা মায়ের মাথাতেই আসেনি কখনো। খেলার সময় শিশুটির শব্দ পেতেন। তখনই বুঝতেন, তার তিন বছরের জয়ন্ত নিজের মতো করেই ঘরের সামনে খেলছে। কিন্তু অনেকক্ষণ সময় ধরে শিশুটির কোনো রা শব্দ নেই। হঠাৎ বিষয়টি মাথায় এলো মায়ের। কী এক অজানা আশঙ্কায় ঘরের ভিতর থেকে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। শিশুটিকে দেখছেন না। কী ব্যাপার! কোথায় গেল জয়ন্ত? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন রাখছেন। এ ঘর থেকে ও ঘর। বাথরুম, বারান্দা এমনটি সামনের উঠানেও। দৌড়াদৌড়ি করছেন মা। এবার চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন। জয়ন্ত! জয়ন্ত! না শিশুটির  শব্দ কোথাও নেই। এবার মা ভয় পান। চিৎকার করে বাড়িঘর মাথায় তোলেন। খবর পেয়ে বাসায় আসেন জয়ন্তের বাবা সনু বাবু। স্ত্রীর মুখে শুনে তিনি ছোটাছুটি করতে শুরু করেন। খবর পেয়ে আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন। তারাও এদিক সেদিক খোঁজ করতে থাকেন। কিন্তু কোথাও জয়ন্ত নেই। ২০১৮ সালের জুলাইয়ের এক সকালে ঢাকার অদূরে সাভারের তেঁতুলঝড়ায় তিন বছরের শিশু নিখোঁজ হয় বাসার সামনে থেকে। সকাল ৯টায় বাসার সামনে খেলছিল জয়ন্ত। কিন্তু ১০টার পর আশপাশের কোথাও আর তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন সনু বাবু একই বাড়ির ভাড়াটে আল আমিনকে নিয়ে পুরো এলাকায় মাইকিং করে বেড়ান। কিন্তু সন্ধ্যার পরও জয়ন্তের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। পরে রাতে জয়ন্তের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় সনু বাবু সাভার থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এ ঘটনা তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয় সাভার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আজগার আলীকে। রাত পৌনে ১০টায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি সনু বাবুকে ফোন করে। ফোনে বলে, ‘আপনার ছেলে আমাদের কাছে আছে, বিকাশ করলে আপনার ছেলেকে ফেরত পাবেন, তা না হলে আপনার ছেলের ক্ষতি হবে।’ পরদিন ২ জুলাই অপহরণকারীদের দেওয়া বিকাশ নম্বরে ৭ হাজার টাকা পাঠান জয়ন্তের বাবা সনু বাবু। কিন্তু জয়ন্তকে ফেরত না পেয়ে সনু বাবু পুলিশকে বিষয়টি জানান। পুলিশের খটকা লাগে। পুলিশ সন্দেহ করছে, সনু বাবুর কাছের লোকজনই এ ঘটনায় জড়িত। পরদিন পুলিশ জয়ন্তদের বাসায় গেল। তখন আশপাশের লোকজন তাদের বাড়িতে আসা যাওয়া করছিল জয়ন্তের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে। পুলিশ এ সময় ছদ্মবেশ নেয়। সনু বাবুর সঙ্গে কথা বলে পুলিশ তার মামা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন আশপাশের লোকজনের কাছে। পাশের বাড়ির যুবক আল আমিন তখন বলেছিলেন, অপহরণকারীদের টাকা দিলে জয়ন্তকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। আল আমিনের এমন বক্তব্যে পুলিশ কর্মকর্তার সন্দেহ হয়। তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যান। পরে তার কাছ থেকে বেরিয়ে আসে খুনের রহস্য।  তিন বছরের শিশু জয়ন্ত নিখোঁজ হওয়ার পর তার খোঁজে মাইকিং করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন আল আমিন। শিশুটির মা-বাবাকে আশ্বাস দেন, জয়ন্তকে নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে। সেই আল আমিনই শিশু জয়ন্তকে খুন করার কথা স্বীকার করে। পরে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জয়ন্তকে নৃশংসভাবে খুন করার চার দিন পর সন্দেহভাজন খুনির নাটকীয় অভিনয়ের বিষয়টি পুলিশের তদন্তে ধরা পড়ে। এ খুনে জড়িত থাকার অভিযোগে সন্দেহভাজন খুনি হিসেবে আল আমিন (১৮) ও নাছির শেখকে (২৬) গ্রেফতার করে সাভার থানার পুলিশ। আল আমিন ঢাকার আদালতে জয়ন্তকে খুন করার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পুলিশ বলেছে, আল আমিন তার খালাতো বোনের স্বামী নাছিরকে নিয়ে জয়ন্তকে হত্যা করে। পরে আল আমিন ফোন করে জয়ন্তের বাবার কাছে ১ লাখ টাকা মুক্তিপণ চায়। জয়ন্তকে কেন খুন করা হয়, সে ব্যাপারে এসআই আজগার বলেন, নাছির শেখ এলাকায় রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। আর আল আমিন বেকার। কিছুই করতেন না। টাকা আদায় করার জন্য জয়ন্তকে অপহরণ করেন তারা। জয়ন্তের মা-বাবা দুজনে সাভারের গার্মেন্টে চাকরি করেন। জয়ন্তের বাবা সনু বাবু বলেন, ‘আমরা কল্পনাও করিনি যে, আল আমিন আমার ছেলে জয়ন্তকে অপহরণ করতে পারে, খুন করতে পারে। জয়ন্তকে যখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন আল আমিন মাইকিং করেছে। জয়ন্তকে খুঁজে পাওয়ার জন্য নানা পরামর্শ দিয়েছে। অথচ আল আমিনই আমার নিষ্পাপ ছেলেকে নির্মমভাবে খুন করেছে।’

সর্বশেষ খবর