শনিবার, ৬ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

প্রতিকার খুঁজতে এসে সমস্যা বাড়ালেন নেতারা

পরিবেশবাদীরা ক্ষুব্ধ

মাহমুদ আজহার, গ্লাসগো (স্কটল্যান্ড) থেকে

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার সমস্যা মোচনে করণীয় নির্ধারণ করতে বিশ্বনেতারা নিজেরাই কার্বন ছড়ালেন। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোর চলমান জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দেন বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশের সরকারপ্রধান। এদের বেশির ভাগই এসেছিলেন নিজেদের ব্যক্তিগত জেট বিমানে চড়ে। ব্যক্তিগত এসব বিমানের একেকটি যেন একেকটি কার্বন-ডাইঅক্সাইড কারখানা। ৪ শতাধিক বিমান মাত্র দুই দিনেই কার্বন ছড়িয়েছে প্রায় ১৩ হাজার টন। এ পরিমাণ কার্বন ছড়াতে স্কটল্যান্ডের ৬০ লাখ নাগরিকের অন্তত এক বছর লাগত। জেনেশুনে এ ঘটনা ঘটানোয় সমালোচনা ও বিতর্কের মুখে পড়েছেন নেতারা। তাদের এ কাজকে ‘চরম মোনাফেকি’ বলতেও দ্বিধা করছেন না সমালোচকরা। কার্বন নিঃসরণের মতো সমস্যার সমাধান খুঁজতে গ্লাসগোয় ৩১ অক্টোবর শুরু হয় কপ২৬ শীর্ষ জলবায়ু সম্মেলন। চলবে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত। জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে প্যারিস চুক্তির পর এ সম্মেলনকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। কেউ কেউ একে পৃথিবী বাঁচানোর ‘সর্বশেষ ভরসা’ অভিহিত করেছেন। সম্মেলন শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকেই গ্লাসগোর প্রেস্টউইক এয়ারপোর্ট ও এডিনবার্গের এডিনবার্গ এয়ারপোর্টের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশের ৩০ হাজার প্রতিনিধির যাতায়াতের জন্য বাড়ে বাণিজ্যিক বিমানের সংখ্যাও। কিন্তু এ কয়েকদিনে শুধু বাণিজ্যিক বিমানই নয়, বিমানবন্দরগুলোয় ভিড় করতে থাকে অসংখ্য ব্যক্তিগত বিমানও।

ভিআইপি জেট বিমানের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় বড় বড় কার্গো বিমান। যেমন ইতালির রোমে জি২০ সম্মেলন শেষে ৮৫টি গাড়ির বিশাল বহর নিয়ে গ্লাসগোয় অবতরণ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ব্যক্তিগত বিমান এয়ার ফোর্স ওয়ান। সম্মেলন নিজের দেশে হলেও এয়ারবাস এ৩২১-এ চড়ে আসেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। ফ্রেঞ্চ কোটাম ০০১ নিয়ে এসেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে নিয়ে এসেছিল কানাডিয়ান এয়ার ফোর্স ভিআইপি। কনরাড অ্যাডেনোয়ারে এসেছিলেন

 জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল। এভাবে জাপানের জাপানিজ এয়ার ফোর্স ওয়ান, ভারতের এয়ার ইন্ডিয়া ওয়ান, অস্ট্রেলিয়ার শার্ক ওয়ান ও ইসরায়েলের উইং অব জায়ন অবতরণ করেছিল তাদের নিজ নিজ দেশের সরকারপ্রধানদের নিয়ে। প্রায় দুই সপ্তাহব্যাপী সম্মেলনের প্রথম সপ্তাহেই কর্মসূচি শেষে নিজেদের সেই ব্যক্তিগত বিমানে করেই নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছেন এসব নেতা। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সানডে মেইল এক রিপোর্টে বলেছে, প্রায় ১ হাজার নেতা ও প্রতিনিধির আনা-নেওয়ায় ব্যবহৃত হয়েছে অন্তত ৪০০ ব্যক্তিগত বিমান। এতে কয়েকদিনেই হাজার হাজার টন কার্বন ছড়িয়েছে সম্মেলনের আয়োজক স্কটল্যান্ডের বায়ুমন্ডলে। বিশ্লেষকদের মতে বিমানের চলাচলের ফলে বিস্তর গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপন্ন হয় বিশেষ করে কার্বন-ডাইঅক্সাইড। কারণ, জ্বালানি তেলে চলে বিমান। উচ্চ মাত্রায় নির্গত কার্বন শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিরই সহায়ক হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণের দিক বিবেচনায় নিলে অন্য যে কোনো ধরনের পরিবহন ব্যবস্থার চেয়ে কয়েক গুণ ক্ষতিকর বিমান পরিবহন। তবে বিমানের এ কার্বন নিঃসরণ অনেকটা তার আকার ও ইঞ্জিনের কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাণিজ্যিক বিমানের চেয়ে অনেক বেশি কার্বন নির্গত করে ব্যক্তিগত বিমানগুলো। লান্ড ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাণিজ্যিক বিমানের চেয়ে প্রায় ৪০ গুণ কার্বন ছড়ায় ব্যক্তিগত জেট বিমান। সানডে মেইলকে এক সাক্ষাৎকারে পরিপ্রণ ও পরিবেশ আন্দোলন গোষ্ঠী ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড এনভারনমেন্টের ম্যাট ফিঞ্চ বলেন, ‘একটা প্রাইভেট জেট চলাচলের সময় প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ২ টন কার্বন নির্গত করে। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না যে জেট বিমান কতটা খারাপ। এটা চলাচলের জন্য সবচেয়ে বাজে পরিবহন। আমাদের এক গবেষণায় উঠে এসেছে কপ২৬-এ যোগ দেওয়া নেতা ও প্রতিনিধিদের বাণিজ্যিক বিমানে করে খুব সহজেই আনা-নেওয়া করা যেত।’

গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু আলোচনায় যোগ দিতে নেতাদের ব্যক্তিগত বিমান চড়ার এ বিলাসিতা নিয়ে বিশ্বজুড়ে অফলাইনে-অনলাইনে তুমুল সমালোচনা চলছে। ব্রিটেনের ইনডিপেনডেন্স পার্টির সাবেক নেতা নাইজেল ফারাজ এক টুইটার পোস্টে নেতাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘কপ২৬-এ যোগ দিতে যারাই জেট বিমান ব্যবহার করেছেন তারা প্রত্যেকেই এক একজন মোনাফেক।’ পরিবেশবাদীরা বলছেন, ‘বিশ্বনেতারা জলবায়ু জরুরি অবস্থা নিয়ে কথা বলছেন, একই সঙ্গে ব্যক্তিগত বিমানেও চড়ছেন। এটা আসলেই জলবায়ু নিয়ে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।’

সর্বশেষ খবর