রবিবার, ৭ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ইউপি ভোটে বেড়েছে ক্ষুদ্র অস্ত্রের চাহিদা

৭০-৮০ হাজার টাকায় মিলছে বিদেশি পিস্তল

আলাউদ্দিন আরিফ

ইউপি ভোটে বেড়েছে ক্ষুদ্র অস্ত্রের চাহিদা

চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুদ্র ও অত্যাধুনিক অস্ত্রের চাহিদা বেড়েছে। সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বিভিন্ন সীমান্ত জেলা দিয়ে প্রবেশ করছে ক্ষুদ্র অস্ত্র। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর প্রতিটি মাত্র ৭০-৮০ হাজার টাকায় বিকিকিনি হচ্ছে। কাঁচামাল, গবাদি পশুসহ বিভিন্ন পণ্যের ট্রাকে অস্ত্র পৌঁছে যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের দুর্বৃত্তদের হাতে। অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে ইউপি নির্বাচনে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা ও আধিপত্য বিস্তারে। ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই, জঙ্গিবাদী কার্যক্রমসহ নানা অপরাধকর্মে ও ব্যবহারের তথ্য পেয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। পুলিশ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্র    উদ্ধারে বিশেষসহ নিয়মিত অভিযান চলছে। কোনো তথ্য পাওয়া মাত্রই র‌্যাব-পুলিশ গুরুত্বসহকারে নিয়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করছে।’

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ইউপি নির্বাচনে প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারে গোলাগুলি ও খুনোখুনি হচ্ছে। ৪ নভেম্বর নরসিংদীর চরাঞ্চল আলোকবালীতে দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে চারজন নিহত ও ৩০ জন আহত হন। একই দিন পটুয়াখালী সদরের লোহালিয়া ইউনিয়নে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারে গোলাগুলি হয়েছে। ১৬ অক্টোবর মধ্যরাতে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার চিৎমরম ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী নেথোয়াই মারমাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এর আগে মাগুরা সদর উপজেলার জগদল ইউনিয়নে নির্বাচনী সংঘর্ষ ও গুলিতে চারজন নিহত হন। প্রথম ধাপের নির্বাচনে কক্সবাজারের মহেশখালীতে সহিংসতায় নিহত হন দুজন ও বরিশালের গৌরনদীতে দুজন। যশোরের বেনাপোল এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অস্ত্র কারবারি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চলমান; তাই অবৈধ অস্ত্রের চাহিদা বেড়েছে। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় তৈরি অস্ত্র তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করেন। এজন্য তাদের একটি সাপ্লাই নেটওয়ার্ক আছে। সীমান্ত পার করে দেওয়া, অস্ত্র বহন করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য আলাদা লোক আছে তাদের। ৯ এমএম, ৭.৬ ও পয়েন্ট ২২ বোরসহ বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে এ চক্রের কাছে। অত্যাধুনিক বিদেশি অস্ত্র বিক্রি হয় ৭০-৮০ হাজার টাকায়। আর ভারত ও শ্রীলঙ্কায় নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি অস্ত্র বিক্রি হয় ৪০-৫০ হাজার টাকায়। অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে সংশ্লিষ্ট ডিবির একজন পরিদর্শক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে অবৈধ পথে আসা সবচাইতে বেশি অস্ত্র তৈরি হয় ভারতের মুঙ্গেরে। সেখানকার তৈরি অস্ত্রের মান ভালো, অত্যাধুনিক এবং কার্যকর। ফলে আন্ডারগ্রাউন্ড সন্ত্রাসীদের কাছে এসব অস্ত্রের চাহিদা বেশি। এ ছাড়া ভারত ও শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন এলাকায় বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কারখানায় অস্ত্র তৈরির তথ্য বিভিন্ন সময় গ্রেফতার কারবারিদের কাছ থেকে জানা গেছে। ইউপিসহ যে কোনো নির্বাচনে আধিপত্য বিস্তার করতে ক্ষুদ্র অস্ত্রের চাহিদা বাড়ে।’ পুলিশ সদর দফতর থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত  বিভিন্ন হত্যাকান্ডের ঘটনায় ৪২টি আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। এর মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ২১টি। চট্টগ্রাম রেঞ্জে হত্যাকান্ডে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হয়েছে ১৫টি, রংপুর রেঞ্জে ২টি, ঢাকা রেঞ্জে ৬টি ও ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) ২টি। একই সময়ে হত্যাকান্ডে দেশি অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে ৭১৬টি। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের সর্বশেষ অপরাধবিষয়ক সভায় বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রতি মাসের শেষ সপ্তাহে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য বিশেষ অভিযান পরিচালনায় সব ইউনিটকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এম খুরশীদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে আমরা সব সময় তৎপর। পুলিশের সব ইউনিটের অভিযান অব্যাহত আছে। এর পরও আমরা প্রতি মাসের শেষ সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোকে অবৈধ অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনার নির্দেশনা দিয়ে তা কার্যকর করছি।’ এলিট ফোর্স র‌্যাব জানায়, চলতি বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে তারা ৪৪৭টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৪ হাজার ২৮৮টি গোলাবারুদ উদ্ধার এবং ৫১৫ জনকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছে। এর আগে ২০২০ সালে ৬৯৮টি অস্ত্র, ৭ হাজার ২৪৯টি গোলাবারুদসহ ৫৪৪ জনকে গ্রেফতার করে। ২০১৯ সালে ২২৩ জনকে গ্রেফতার করা হয় ১১৯টি অস্ত্র ও ১ হাজার ১৩৭টি গোলাবারুদসহ। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের পাশের দুটি দেশ থেকে অভিনব কৌশলে অবৈধ অস্ত্র আসছে। আমরা এসব অবৈধ অস্ত্রের কারবারি, ক্রেতা, বিক্রেতাসহ সবার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। আমাদের নিজস্ব গোয়েন্দা নেটওয়ার্কসহ যখনই কোনো সূত্রে খবর পাই তখনই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করি।’

বিজিবিসূত্র জানান, অক্টোবরে তারা সীমান্ত এলাকা থেকে ৪টি পিস্তল, ৩টি ম্যাগাজিন ও ২৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে। এ বিষয়ে বিজিবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্র ও মাদকের বিষয়ে সীমান্তে সব সময় আমাদের নজরদারি অব্যাহত আছে।’ ৩১ অক্টোবর রাজধানীর সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে ৫টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৩০১ রাউন্ড গুলিসহ চারজনকে গ্রেফফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। সংস্থার প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান জানান, গ্রেফতার লাল তন পাংখোয়া রাঙামাটির বরকল সীমান্ত দিয়ে ভারতের মিজোরাম থেকে অস্ত্র-গুলি এনে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল, ঢাকা ও কক্সবাজারে বিক্রি করতেন। কিছু অস্ত্র তারা কক্সবাজারের বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছেও সরবরাহ করতেন। সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের উপ-পুলিশ কমিশনার আবদুল মান্নান বলেন, ‘ইউপি নির্বাচনে অস্ত্র কারবারিদের এ গ্রুপটির অবৈধ অস্ত্র সরবরাহের কোনো তথ্য আমরা পাইনি। রিমান্ডে তাদের এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’ অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্র আসার ক্ষেত্রে একজন ডিলার, একজন ক্যারিয়ার বা বহনকারী ও একজন ইউজার আছে। সব জায়গায় নিয়ন্ত্রণ না করে এক জাগয়ায় নিয়ন্ত্রণ করলে হবে না। সব জায়গায় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ইউপি নির্বাচনসহ সব ক্ষেত্রে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার কমে আসবে।’

সর্বশেষ খবর