সোমবার, ৮ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মোবাইলের সিম চেনাল সিরিয়াল কিলারকে

মির্জা মেহেদী তমাল

মোবাইলের সিম চেনাল সিরিয়াল কিলারকে

একের পর এক লাশ উদ্ধারে পুলিশের মধ্যেও এক ধরনের আতঙ্ক শুরু হয়েছে। রীতিমতো ভৌতিক কোনো বিদেশি মুভির মতোই ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। শ্রেণি-পেশায় মিল ছিল না কোনো লাশের। তবে একটি জায়গায় মিল ছিল, সব লাশই নারীর। ধর্ষণের পর কে বা কারা তাদের খুন করে ফেলে রাখছে। খালে, বিলে, নদীতে মিলছে তাদের লাশ। কিন্তু ঘটনার কূল-কিনারা করতে না পারায় পুলিশ দিশাহারা। চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে এমন ছয় নারীর লাশ উদ্ধারের পর গোটা এলাকায় নারীদের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

সর্বশেষ ২০০৯ সালের ২১ জুলাই এক নারীর লাশ উদ্ধার হয়। সেটি নিয়েই পুলিশ তদন্ত শুরু করে। পুলিশের ধারণা, একটি ঘটনার রহস্য উদঘাটনেই বেরিয়ে আসতে পারে সব খুনের রহস্য। নারীর পরিচয় বের করতে পুলিশ যখন পাগলের মতো হন্যে হয়ে খুঁজছে, ঠিক সেই সময়ে একটি ফোন কল আসে ফরিদগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে। স্যার, আমি রিকশাচালক কবির বলছি (ছদ্মনাম)। যে মহিলার লাশ পাওয়া গেছে, সেই মহিলা আমার রিকশায় চড়েছিল। গ্রামের রফিক আর সুমন (ছদ্মনাম) ওই নারীকে বাসস্ট্যান্ড থেকে নিয়ে হাসা গ্রামের বিলের পাশে নিয়ে গেছে। তারাই নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে। এমন তথ্যের পর পুলিশ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির দেখা পেল। সেই দিনই পুলিশের দল হাসা গ্রামে অভিযান চালিয়ে দুই যুবককে গ্রেফতার করে। থানায় নিয়ে তাদের জেরা করা হয়। কিন্তু রাতভর জিজ্ঞাসাবাদেও পুলিশ কোনো তথ্য পেল না। পুলিশ নিশ্চিত, তাদের বিভ্রান্ত করতেই দুই যুবককে জড়িয়ে তথ্য দিয়েছে।

পুলিশ এবার সেই ফোন নম্বরের দিকে নজর দেয়। কল করে। কিন্তু ফোনটি বন্ধ। ফোনটি আর খোলা পায় না পুলিশ। তদন্ত করতে যেয়ে পুলিশ হতাশ। আর কোনো সূত্রই খুঁজে পায়  না পুলিশ। দীর্ঘ এক মাস পর পুলিশ আবারও চেষ্টা করে সেই নম্বরে। এবার খোলা পাওয়া যায়। পুলিশ এবার বেশ উত্তেজনায়। ফোন নম্বর থেকে অবশ্যই কিছু না কিছু পাওয়া যাবে। ওই ফোন নম্বরে ফোন করে পুলিশ জানতে পারে, ফোনটি গাজীপুর বাজারের আখ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কেনা হয়েছে। পুলিশ আখ ব্যবসায়ী তাজুকে আটক করলে তিনি জানান, রসু খাঁ ও মিজান নামের দুই ব্যক্তি তাদের মসজিদ থেকে ফ্যান চুরি করতে গেলে তিনি ও নৈশপ্রহরী মিলে তাদের দুজনকে হাতেনাতে আটক করেন। তখন তিনি রসু খাঁর কাছ থেকে সিমটি কেড়ে নিয়েছিলেন। পরে তিনি সেটি ১০০ টাকায় বিক্রি করে দেন। পুলিশ নিশ্চিত হয়, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রথম ফোনটি করেছিলেন রসু নিজে। তাজুর দেওয়া সূত্র অনুযায়ী টঙ্গীর মিরাশপাড়া থেকে পুলিশ রসুকে গ্রেফতার করে। প্রথম দিকে রসু কোনো তথ্য স্বীকার করেননি। এরপর জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করলে রসু খাঁ পুলিশকে গালমন্দ করতে থাকেন এবং পাগলের অভিনয় শুরু করেন। পুলিশ জেরা অব্যাহত রাখলে একপর্যায়ে তিনি পারভিন নামের নারীকে খুনের কথা স্বীকার করেন। পরে তাঁকে আরও নিবিড়ভাবে জেরা করা হলে তিনি একে একে চাঁদপুর এলাকায় ১১টি খুনের কথা স্বীকার করেন। এরপর আদালতে নেওয়া হলে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন। রসু খাঁর গ্রেফতারের পর সারা দেশে শুরু হয় তোলপাড়। শুধু ফরিদগঞ্জের ছয়টিই নয়, রোমাঞ্চকর গল্পের চরিত্রের মতো ১১ নারীকে খুন করে নিরাপদে পালিয়ে ছিল রসু খাঁ। স্বীকার করে পুলিশের কাছে। স্বীকার করে ১০১ নারীকে খুন করার শপথ নেওয়ার কথা। এই শপথ নিয়ে ২০০৭ সালে নেমে পড়েন বীভৎস কিলিং মিশনে। খুনের ঘটনাগুলো ফাঁস হওয়ার পর মানুষ স্তম্ভিত। দুনিয়ার কুখ্যাত সব সিরিয়াল কিলারের হত্যার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে বিশেষ ধরনের বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। চাঁদপুরের সিরিয়াল কিলার রসু খাঁও এর ব্যতিক্রম নন। তিনি খুন করেছেন নারীদের। সেই নারীরা সবাই হতদরিদ্র পরিবারের। এদের একজন ছাড়া সবাইকে তিনি খুনের আগে ধর্ষণ করেছেন। সবাইকে খুন করেছেন রাতের বেলায়। সবাইকে খালের কিনারে নিয়ে খুন করেছেন এবং সবার লাশও ফেলে রেখেছিলেন খালের পাশেই। কোনো খুনের ঘটনার সঙ্গে রসু খাঁ তাঁকে শনাক্ত করার মতো কোনো চিহ্ন রেখে যাননি। রসুর বাড়ি চাঁদপুর সদর উপজেলার চান্দ্রা ইউনিয়নের মদনা গ্রামে। নরপিশাচ রসু খাঁ জেলখানায় বন্দী। বীভৎস সেই সব খুনের ঘটনায় সে এখন বিচারের মুখোমুখি। চাঁদপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ অরুনাভ চক্রবর্তী একটি হত্যা মামলায় এই সিরিয়াল কিলার রসু খাঁর ফাঁসির রায় দিয়েছেন। রসু পুলিশি জেরায় বলেছে, বিয়ের আগে তিনি একটি মেয়েকে ভালোবাসতেন। কিন্তু তার ভাইয়েরা মেরে তার হাত ভেঙে দেন। এর পরই সে খুনের পরিকল্পনা করে। একে একে খুন করতে থাকে। সে পুলিশকে জানায়, আমি আমার অপমানের প্রতিশোধ নিতে খুন করি। ১০১ খুনের পর আর খুন করতাম না। আমি সন্নাসী হতাম। মাজারে মাজারে ঘুরতাম। পুলিশ তার কাছ থেকে জানতে পেরেছে, নানা কৌশলে মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তাদের নিয়ে অভিসারে যাওয়ার কথা বলে একের পর এক হত্যা করত রসু খাঁ। শুধু খুনেই এই নরপিশাচের প্রতিহিংসার সমাপ্তি ঘটেনি, খুনের আগে ওই নারীদের ধর্ষণও করে সে।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর