মঙ্গলবার, ৯ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

গরিবের তহবিলে ধনীদের থাবা

উদ্বিগ্ন বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো

মাহমুদ আজহার, গ্লাসগো, (স্কটল্যান্ড) থেকে

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তহবিলে ভাগ বসাতে মরিয়া প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর বিভিন্ন করপোরেট সংস্থা। গ্লাসগোর কপ সম্মেলনে স্পন্সর করা করপোরেট সংস্থা মাইক্রোসফট, ইউনিলিভার, হিটাচি, গ্লাক্সো-স্মিথক্লাইন, জাগুয়ার-ল্যান্ড রোভার, আইকিয়ার কাজ করছে। এসব সংস্থা এখন গরিব দেশগুলোর জন্য বরাদ্দ থাকা জলবায়ু তহবিলে ভাগ বসাতে নানা দেন-দরবার করছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল ও গরিব রাষ্ট্রগুলো। গ্লাসগোয় অবস্থান করা পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংস্থা এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।

কপ মূল সম্মেলন ভবনের অদূরে ‘গ্রিন জোন’ নামে আলাদা একটি ভেন্যু তৈরি হয়েছে, যেখানে রয়েছে বেশ কিছু কোম্পানি। সেখানে তারা তাদের উদ্ভাবিত নবায়নযোগ্য জ্বালানি-নির্ভর যানবাহন, যন্ত্রপাতি প্রদর্শন করছে। এসব সংস্থাই এখন জলবায়ু তহবিলে ভাগ বসাতে চাইছে। কপ সম্মেলন কেন্দ্রে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পর্যবেক্ষক হিসেবে আসা পরিবেশ ও মানবাধিকারকর্মী কেট রবিনসন করপোরেট খাতের এ সরব গতিবিধিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, আমার মনে হচ্ছে জাতিসংঘের একটি আয়োজন করপোরেট খাত দখল করে নিয়েছে। এমন সব কোম্পানি স্পন্সর হিসেবে হাজির হয়েছে যারা নিজেরাই তেল-গ্যাস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। জেফ বেজোস বিশ্ব নেতাদের পাশে দাঁড়িয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায়বিচার নিয়ে কথা বলছেন। এটা সত্যিই তামাশা।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, জলবায়ু সম্মেলনে বেসরকারি কোম্পানির আনাগোনা একেবারে নতুন কিছু নয়। ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনেই প্রথমবারের মতো কয়েকটি কোম্পানি স্পন্সর হিসেবে হাজির হয়েছিল। কিন্তু গ্লাসগোয় বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানির উপস্থিতি এতটাই  সরব যে তা নিয়ে বিশেষ করে দরিদ্র-অনুন্নত দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে সন্দেহ-উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে গ্লাসগো সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ২০১৫ সাল থেকে জলবায়ু তহবিলে, জলবায়ু প্রকল্পে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্তি নিয়ে যে কথা শুরু হয়, তা গ্লাসগোয় অনেক বেড়েছে। আমার মনে হয়, যেসব কারণে গ্লাসগো সম্মেলন নিয়ে ভবিষ্যতে কথা হবে তার প্রধান একটি হবে যে এখান থেকেই জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত নীতি-পরিকল্পনায় সাফল্যের সঙ্গে বেসরকারি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, জলবায়ু তহবিলে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্তি নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ছে অনুন্নত এবং দরিদ্র দেশগুলো। বিশেষ করে যারা জলবায়ুর পরিবর্তনের পরিণতিতে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এসব দেশের কাছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ঝড়-বন্যা প্রতিরোধে বাঁধ তৈরি, আর খরা-বন্যা-ভাঙন-লবণাক্ততায় বাস্তচ্যুত মানুষদের পুনর্বাসন। ফলে, এসব দেশ ভয় পাচ্ছে বেসরকারি খাত অতিরিক্ত সম্পৃক্ত হলে জলবায়ু মোকাবিলার কৌশলের অগ্রাধিকার বদলে যাবে। দুর্গত মানুষের পুনর্বাসন বা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজনে তাদের সক্ষমতা তৈরির চেয়ে গরিব দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ হ্রাসকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে সামনে আনার চেষ্টা হতে পারে।

কেন গরিব দেশগুলো ভয় পাচ্ছে, সংকট কোথায়? এমন প্রশ্নে ব্রিটেনের গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান অর্থনীতিবিদ পল স্টিল বলেন, মিটিগেশন অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণ কমানোর পেছনে পয়সা দেওয়ার ব্যাপারেই পশ্চিমা দেশের আগ্রহ বেশি। তা হলেই পশ্চিমা দেশের বেসরকারি খাত ব্যবসা পাবে। জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে বছরে ১৩০ ট্রিলিয়ন ডলার তহবিলের কথা উঠছে। এর সিংহভাগই আসলে খরচ হবে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কাজে। কারণ এটি ভবিষ্যতে একটি বড় ব্যবসার সুযোগ তৈরি করবে। আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে গ্লাসগো সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন উসুতু কামারা। তিনি বলেন, জলোচ্ছ্বাস এবং সাইক্লোনে তার দেশের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু অবকাঠামো এবং খোদ রাজধানী শহর চরম হুমকিতে পড়লেও এসব রক্ষার কাজে আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে তেমন কোনো টাকা তারা পাচ্ছেন না। বরং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সে কাজ তাদের করতে হয়েছে। যে টাকা দেওয়া হচ্ছে তা মূলত কার্বন নিঃসরণ কমানোর কাজে। কারণ তাতে হয়তো ব্যবসা হয়, মুনাফা হয়। সে কারণেই ধনী দেশগুলো এদিকে নজর দিচ্ছে বেশি।

সর্বশেষ খবর