শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মেধাবীরা পুলিশের কনস্টেবল পদে নিয়োগ পাওয়ায় উচ্ছ্বাস

আলাউদ্দিন আরিফ

লাভলী আক্তারের বাবা অটোরিকশা চালক। ঘামঝরা পরিশ্রমের টাকায় মেয়েকে তিনি এসএসসি পাস করান। স্বপ্ন দেখেন তার মেয়ে একদিন পুলিশ হবে। এরপর লাভলী ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল পদে পরীক্ষা দেন। তার বাবা ধরেই নিয়েছিলেন ‘টাকাপয়সা ছাড়া পুলিশের চাকরি হবে না’। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে পুলিশ লাইনসে গিয়ে পুলিশ সুপারের বক্তব্য শুনে আস্থা ফিরে পান। পুলিশ সুপার তার বক্তব্যে বলেন, ‘চাকরি হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে। কারও কোনো টাকাপয়সা লাগবে না।’ পরে লাভলীর বাবা আবদুুল হামিদ বলেন, ‘পুলিশ এবার স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করায় আমাদের মতো অসহায় গরিব মানুষের মেয়ের পুলিশে চাকরি হয়েছে।’ লাভলীর বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বিদ্যানন্দ গ্রামে। দুই ভাই-বোনের মধ্যে বড়। আবদুুল হামিদ অটোরিকশা চালক। মাত্র ১৩৩ টাকা খরচে মেয়ের চাকরি হওয়ায় তিনি মহাখুশি। লাভলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল পুলিশে চাকরি করব। দেশের মানুষের সেবা করব। চাকরি হবে কি না এ নিয়ে শঙ্কিত ছিলাম। শেষ পর্যন্ত যোগ্যতাবলেই আমার চাকরি হয়েছে। কোনো তদবির করতে হয়নি। এতে আমি মহাখুশি।’ পুলিশ সদর দফতর জানায়, এবার বাংলাদেশ পুলিশে মেধা ও শারীরিক যোগ্যতার ভিত্তিতে অধিকতর যোগ্য প্রার্থীদের কনস্টেবল পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। দেশের সব জেলায় কনস্টেবল পদে নিয়োগ চলছে। এরই মধ্যে ফরিদপুর, রাজবাড়ী, ময়মনসিংহ, চাঁদপুর, খাগড়াছড়ি, খুলনা, ঝিনাইদহ, নওগাঁ, লালমনিরহাট, পটুয়াখালী মিলিয়ে ১০ জেলায় নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। বিনা তদবির ও বিনা ঘুষে চাকরি হওয়ায় অভিভাবকরা খুবই খুশি। এ ১০ জেলায় পুরুষ কনস্টেবলের ৩৬৫ পদের বিপরীতে ৩ হাজার ৫০৭ এবং নারী কনস্টেবলের ৬৪ পদের বিপরীতে ৩৪৭ জন প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয়েছেন ৪২৯ জন। কনস্টেবল পদে নিয়োগে স্বচ্ছতর বিষয়ে জানতে চাইলে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে বাংলাদেশ ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হবে। বাংলাদেশ পুলিশকে উন্নত দেশের উপযোগী করার লক্ষ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। এবার স্বচ্ছতার সঙ্গে অধিকতর যোগ্য কনস্টেবল নিয়োগ সে প্রক্রিয়ারই অংশ। এজন্য আমরা এরই মধ্যে নিয়োগবিধিও সংশোধন করেছি।’ আইজিপি আরও বলেন, ‘আমরা মেধা এবং শারীরিকভাবে সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থীদের বাছাই করছি। নতুন নিয়োগবিধি অনুযায়ী মেধা ও শারীরিকভাবে অধিকতর যোগ্য প্রার্থীরাই এবার কনস্টেবল পদে নিয়োগ পাচ্ছেন। আগামীতে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর এবং সার্জেন্ট পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও মেধা ও শারীরিকভাবে যোগ্যরাই নিয়োগ পাবেন।’ এবারের নিয়োগ ‘ইতিহাসে সর্বাধিক স্বচ্ছ ও সুন্দর’ উল্লেখ করে ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সুপার মোহা. আহমার উজ্জামান বলেন, ‘আজইপির নেতৃত্বে আমরা একটি স্বচ্ছ ও সুন্দর নিয়োগ উপহার দিতে পেরেছি। মাঠপর্যায়ে শারীরিক পরীক্ষা নিয়ে অধিকতর যোগ্য প্রার্থী বাছাই করেছি। এরপর লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্র কোডিং করে মূল্যায়ন করা হয়েছে। কার খাতা কে দেখে তা বোঝার কোনো সুযোগ ছিল না। ভাইভা ও মনস্তাত্তি¡ক পরীক্ষাও নেওয়া হয়েছে সুন্দরভাবে।’ সাত ধাপে সম্পন্ন হওয়া এ নিয়োগকে ইতিহাসে বিরল উল্লেখ করে জেলা পুলিশ সুপার বলেন, ‘সত্যিকারের মেধাবী ও যোগ্যদের নিয়োগ দিতে এবং এ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় থাকতে পেরে আমি নিজেও ইতিহাসের অংশ হতে পেরেছি। এজন্য আইজিপিসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’ জানা গেছে, সংশোধিত নিয়োগবিধিতে কনস্টেবল পদে সাত ধাপে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ২৫ অক্টোবর। সাত ধাপের মধ্যে রয়েছে- প্রথম ধাপে প্রাথমিক বাছাই, দ্বিতীয় ধাপে শারীরিক মাপ এবং ফিজিক্যাল এনডুরেন্স টেস্ট, তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষা, চতুর্থ ধাপে মনস্তাত্তি¡ক ও মৌখিক পরীক্ষা, পঞ্চম ধাপে প্রাথমিক নির্বাচন, ষষ্ঠ ধাপে পুলিশ ভেরিফিকেশন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সপ্তম ও সর্বশেষ ধাপ হলো চূড়ান্তভাবে প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্তকরণ। প্রার্থীদের শারীরিক সক্ষমতা সাত ইভেন্টের মধ্য দিয়ে যাচাই করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে- সম্পূর্ণ যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষায় দিনমজুর, কৃষক, অটোভ্যান চালকসহ সাধারণ পরিবারের সন্তানরা চাকরি পেয়েছেন বেশি। কোনো ধরনের তদবির বা অর্থ ছাড়া শুধু মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কনস্টেবল পদে চাকরি পাওয়া সাধারণ পরিবারের সদস্য ও তাদের বাবা-মার জন্য ছিল স্বপ্ন। কৃষক পরিবারের সন্তান সানজিদা আক্তারের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ভাংনামারী। ময়মনসিংহ মহানগরের মুসলিম গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। নিজের লেখাপড়ার খরচ চলে টিউশনি করে। বাবার সংসারে সাত সদস্যের মধ্যে বড় মেয়ে সানজিদা। স্বপ্ন ছিল পুলিশে চাকরি করার। কীভাবে চাকরি হবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল। আবেদন করে লাইনে দাঁড়ালে যাচাই-বাছাইয়ে মেধা ও যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হয়। বিনা টাকায় চাকরি হওয়ায় সে অনেক খুশি। ৪ নভেম্বর চূড়ান্ত ফল ঘোষণার দিন নিজের নাম দেখে আনন্দের অশ্রুতে চোখ ভরে যায় সানজিদা ও তার বাবার। বাবা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির দিন আজ। মাগনা চাকরি হয় এইড্যা আইজই দেখলাম।’ ময়মনসিংহ সদরের দাপুনিয়া গ্রামের রোজ হিসেবে কাজ করা বিল্লাল হোসেনের ছেলে আলমগীর হোসেন। পুলিশে চাকরি করা স্বপ্ন ছিল তার। তবে স্বপ্নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল দরিদ্রতা। বাবা বিল্লাল হোসেন চোখের পানি ছেড়ে বলেন, ‘আমার যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে সরকারি চাকরি তো সোনার হরিণ। সেই সোনার হরিণ আলমগীর ধরতে পেরেছে। তার খরচ হয়েছে মাত্র ১৩৩ টাকা। আবেদন ফরম পূরণ করে লাইনে দাঁড়ায়। এরপর সব বাছাইয়ে মেধা ও যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হয়।’ ফলাফল ঘোষণার পর বাবাকে ধরে কেঁদে ফেলে আলমগীর। তিনি বলেন, ‘দিনমজুর বাবার দরিদ্র পরিবারের ছেলে আমি। তিন বেলা ঠিকমতো খেতেই পারি না। আমার তো লোক ধরা বা তদবির করার সুযোগ নেই। সেখানে আমি টিকে গেছি। নিয়োগে স্বচ্ছতা না থাকলে এটা সম্ভব হতো না।’ ফুলপুরের অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য দুলাল মিয়ার (৫০) মেয়ে তানিয়া সুনতানা জুঁই। তারও চাকরি হয়েছে কোনো টাকাপয়সা ছাড়াই। জুঁই বলেন, ‘মা বেঁচে থাকলে চাকরির খবরে অনেক ভালো লাগত।’ চার ভাই-বোনের মধ্যে জুঁই সবার ছোট। চলমান কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষা পাঁচ ধাপে ২৬ নভেম্বর শেষ হবে।

 

সর্বশেষ খবর