সোমবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

আমিরাতে ২১৩ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা চাইবে বাংলাদেশ

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

করোনা মহামারীর পর দেশের অর্থনীতিতে গতি আনতে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাণিজ্য সম্প্রসারণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যের এই শক্তিশালী অর্থনীতির দেশটির কাছে ২১৩টি পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা চাইবে বাংলাদেশ। যেসব পণ্যে শুল্ক সুবিধা চাওয়া হবে তার মধ্যে তৈরি পোশাক, ফার্মাসিউটিক্যাল, কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত পণ্যসহ দেশের প্রধান প্রধান রপ্তানি পণ্যগুলো রয়েছে। সরকারি সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে পঞ্চম জয়েন্ট কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে আজ ঢাকায়। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং আরব আমিরাতের পক্ষে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন দেশটির পররাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আহমেদ আল সায়েঘ। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নির্ধারিত পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধার প্রস্তাব দেওয়া হবে।

বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের কৌশল হিসেবে আমরা ইউরোপ-আমেরিকার পর এবার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রপ্তানি সম্প্রসারণে গুরুত্ব দিচ্ছি। সে লক্ষ্যে আমিরাতের কাছে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা চাওয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, উপসাগরীয় দেশগুলোর অর্থনৈতিক জোট ‘গলফ ইকোনমিক কাউন্সিলভুক্ত দেশ বা জেসিসিতে আছে কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন ও সৌদি আরব। জেসিসিভুক্ত দেশগুলোতে পোশাক পণ্য রপ্তানির বড় বাজার রয়েছে। আছে ওষুধসহ কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত পণ্যের বিপুল চাহিদা। বর্তমানে হালাল পণ্যের বড় বাজার গড়ে উঠেছে সেখানে। কিন্তু জেসিসির কাস্টমস ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো চুক্তি না থাকায় মধ্যপ্রাচ্যে কোনো বাজার সুবিধা মিলছে না। সরকার মনে করছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত জেসিসির অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ। সেখানে শুল্ক সুবিধা পাওয়া গেলে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতেও বাজার সুবিধার পথ খুলে যাবে। সরকারের সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু পণ্যের বাজার সুবিধাই নয়, দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে যাতে পারস্পরিক সম্পর্ক আরও জোরদার হয়, এবারের জয়েন্ট কমিশনে সে উদ্যোগও থাকবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও আমিরাতের বাণিজ্য সংগঠনের মধ্যে কয়েক বছর আগে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়েছিল। এবারের জেসির বৈঠকে ওই সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী ব্যবসায়ীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কীভাবে আরও জোরদার করা যায় সে কৌশল নিয়েও আলোচনা হবে। ওই কর্মকর্তা জানান, জয়েন্ট কমিশনের বৈঠকে সরকারি প্রতিনিধিরা নেতৃত্ব দিলেও এবারের আলোচনায় বেসরকারি খাত সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে। বিশেষ করে আরব আমিরাতের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বেসরকারি কোম্পানিগুলো যাতে অংশীদারত্ব বা পার্টনারশিপ বাণিজ্যে যেতে পারে সে উপায় খুঁজে বের করা হবে। এ ছাড়া ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন দেশটি সফর করেন, তখন যেসব সমঝোতা চুক্তি ও বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, সেগুলোরও ফলোআপ হবে কমিশনের বৈঠকে। সূত্র জানায়, করোনা মহামারীর আগে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর দুবাই সফরে দেশটির সঙ্গে চারটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে গভর্নমেন্ট অব দুবাইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) চুক্তি যাতে সই করেছিলেন তখনকার নৌপরিবহন সচিব আবদুস সামাদ ও ডিপি ওয়ালেএর্ডর চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদ বিন সুলায়েম। বাংলাদেশে সমুদ্র বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন ও শিল্প পার্ক স্থাপনে এই চুক্তি হয়েছিল। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এমিরেটস ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানির আরেকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছিল, যেটার মাধ্যমে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি সরবরাহ, পায়রাতে ভূমিভিত্তিক এলএনজি রিসিভিং সেন্টার করার প্রস্তাব ছিল। তৃতীয় সমঝোতা স্মারক সই হয়েছিল আমিরাতের রাজপরিবারের সদস্য ও বিনিয়োগকারী শেখ আহমেদ ডালমুখ আল মাখতুম এবং পিডিবির চেয়ারম্যানের সঙ্গে। এর আওতায় দুই ধাপে ৮০০ থেকে ১০০০ মেগাওয়াটের এলএনজি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ এবং ১০০ মেগাওয়াটের আরেকটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব ছিল। চতুর্থ সমঝোতা স্মারকটি ছিল মাতারবাড়ীতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ওই সফরে আমিরাতের সরকার ও রাজপরিবার বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি, বন্দর ও অবকাঠামো উন্নয়নে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আশ্বাস দিয়েছিলেন, স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। তবে এর পরপরই করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ায় সারা বিশ্ব লকডাউনে চলে যায়। সে কারণে ওইসব বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে কোনো ধরনের ফলোআপ মিটিং করা সম্ভব হয়নি। এখন ওই বিনিয়োগ প্রস্তাবগুলো দেশে আনার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। একই সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ানোর বিষয়েও অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কাজ করছে। জানতে চাইলে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আরব আমিরাত মূলত বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী। এ ছাড়া বন্দরের উন্নয়নেও তারা কাজ করতে চায়। তবে এসব খাতের বাইরে সরকার এখন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ আমিরাতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে পারলে এটি শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করবে তাই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের ব্যবসায়ীরাও এ দেশের সম্ভাবনাময় খাতে যৌথ বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।

সর্বশেষ খবর