মঙ্গলবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা
সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা খুন

জুতার সূত্র ধরে শনাক্ত পরিকল্পনাকারী

নিজস্ব প্রতিবেদক

গম গবেষণা কেন্দ্রের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনোয়ার শহিদ হত্যার মূল পরিকল্পনাকারীকে জুতার সূত্র ধরে শনাক্ত করেছে র‌্যাব। রবিবার রাজধানীর গাবতলী থেকে ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ জাকির হোসেনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ‘ভাড়াটে খুনি’ সাইফুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়।

খুনের পরিকল্পনা করেই গত ১০ নভেম্বর দিনাজপুর থেকে ঢাকায় এসে ওঠেন কল্যাণপুরের একটি আবাসিক হোটেলে। হত্যার পর ওই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার জমি-জমার জাল কাগজপত্র বানিয়ে আত্মসাতের পরিকল্পনা ছিল তাদের।  গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব জানান লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ঢাকা এসে মোবাইলফোনে যোগাযোগ না করে আনোয়ার শহিদের বাসায় গিয়ে দেখা করেন হত্যার ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ জাকির হোসেন। এ সময় পরদিন শ্যামলীতে আসার অনুরোধ করে চলে আসেন জাকির হোসেন। হোটেলে ফিরে ‘খুনি’ সাইফুল ইসলামের সঙ্গে বসে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। পরে হোটেলের পাশের দোকান থেকে ছুরি কেনেন তারা। গত ১১ নভেম্বর সন্ধ্যায় কল্যাণপুরের বাসা থেকে আনোয়ার শহিদ শ্যামলীতে আসেন। বাসায় বলে আসেন দিনাজপুর থেকে একজন এসেছেন, তার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। শ্যামলীতে এসে আনোয়ার শহিদ জাকির হোসেনের সঙ্গে দেখা করেন। জাকির কেনাকাটার কথা বলে স্থানীয় একটি সুপারশপে নিয়ে যান তাকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মার্কেট থেকে বের হয়ে গলিতে যান তারা। সেখানে আগে থেকে প্যান্টের পকেটে ছুরি নিয়ে ওত পেতে ছিলেন সাইফুল ইসলাম। গলিতে এসেই কিছুটা দূর থেকে সাইফুলকে ইশারা দেন জাকির হোসেন। ইশারা পেয়ে আনোয়ার শহিদকে ছুরিকাঘাত করে হোটেলে ফিরে আসেন সাইফুল ইসলাম। তাকে ছুরিকাঘাতের ঘটনাটি পাশের ভবনের সিসিটিভিতে ধরা পড়ে। কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, খুন করে হোটেলে ফিরে শার্ট ও প্যান্ট পরিবর্তন করে দিনাজপুর যাওয়ার জন্য টিকিট কাটতে গাবতলী বাস কাউন্টারে যান তারা। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ ও বাস কাউন্টারের ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়- তারা জামা-কাপড় পরিবর্তন করেছেন। তবে হত্যার ‘পরিকল্পনাকারী’ জাকির হোসেন তার পায়ের জুতা পরিবর্তন করেননি। সেই জুতার সূত্র ধরে জাকিরকে শনাক্ত করা হয়। খুনের নেপথ্যের কারণ জানিয়ে তিনি বলেন, নিহত বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনোয়ার শহিদ দিনাজপুর কর্মরত থাকাকালীন জাকিরের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়। দিনাজপুরে জমি কেনার সময় জাকির দালাল হিসেবে মধ্যস্থতা করেন। জাকির হোসেন বিভিন্ন সময় আনোয়ার শহিদের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা ধার হিসেবে নিয়েছিলেন। আনোয়ার শহিদ অবসর গ্রহণের পর ঢাকায় বসবাস শুরু করলেও পূর্ব ঘনিষ্ঠতার সুবাদে জাকিরের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে যোগাযোগ হতো। এক বছর আগে জাকির হোসেন নিজের চালের গুদাম বন্ধক রেখে ২০ লাখ টাকা ঋণ পাইয়ে দিতে আনোয়ার শহিদের সহযোগিতা চান। তাকে সহযোগিতা করতে রাজি হননি তিনি। এ ছাড়াও পাওনা টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য জাকিরকে চাপ দেন। এ লেনদেন সম্পর্কে আনোয়ার শহিদ ও জাকির হোসেন ছাড়া কেউ জানতেন না। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে জাকির ৬/৭ মাস আগে শহিদকে হত্যার পরিকল্পনা করেন, যাতে ধার করা টাকা ফেরত দিতে না হয়। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জাকির তার চাতালশ্রমিক সাইফুল ইসলামকে হত্যার জন্য ভাড়া করেন। হত্যার পর তারা একসঙ্গে দিনাজপুরে যাওয়ার জন্য বাসের টিকিট কাটেন। রাত আটটায় তাদের বাস দিনাজপুরের উদ্দেশে ছাড়ার কথা ছিল। দিনাজপুর থেকে এক ব্যক্তি জাকির হোসেনকে ফোন দিয়ে জানান আনোয়ার শহিদ ছুরিকাঘাত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। তখন দিনাজপুরে না গিয়ে নিজেকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখতে হাসপাতালে যান জাকির। এরপর দিনাজপুর চলে যান। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর তারা দুজন দিনাজপুর থেকে আত্মগোপনে চলে যান। তারা এ সময় বেশ কয়েকটি স্থান পরিবর্তন করেন। সর্বশেষ তারা গাবতলী এলাকায় এসে আত্মগোপনে যান। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সেখান থেকে তাদের গ্রেফতার করে র‌্যাব। পরে আদাবর থানায় নিহতের ছোট বোন ফেরদৌস সুলতানার করা হত্যা মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়। র‌্যাব জানায়, চাকরিজীবনে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনোয়ার শহিদ  ১৯৯০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দিনাজপুরে কর্মরত ছিলেন।

 তিনি ১৯৭৬ সালে গম গবেষণাকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি শুরু করেন। সর্বশেষ গাজীপুরের জয়দেবপুর গম গবেষণাকেন্দ্র থেকে ২০০৮ সালে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার পদ থেকে অবসর নেন। অবসরের পর কল্যাণপুরে বোনের বাসায় থাকতেন। বাড়ি নীলফামারীর ডোমারে। স্ত্রী ও সন্তান না থাকায় তিনি সব সময় দিনাজপুর ও নিজ এলাকার গরিবদের সহায়তা করতেন। আত্মীয়স্বজনদেরও তিনি নিয়মিত আর্থিক সহায়তা দিতেন। জাকির হোসেন আনোয়ার শহিদের জমি-জমার সব তথ্য জানতেন। যেহেতু তার কোনো সন্তান ছিল না, তাই তাকে হত্যার পর জমির জাল কাগজপত্র বানিয়ে আত্মসাতের পরিকল্পনা ছিল জাকিরের।

সর্বশেষ খবর