বুধবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

অর্থনীতিতে অস্বস্তি

নিয়ন্ত্রণে নেই পণ্যমূল্য ♦ মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয় - রাজস্বে নিম্নগতি ♦ চ্যালেঞ্জ রপ্তানি ও রেমিট্যান্স খাতে

মানিক মুনতাসির

অর্থনীতিতে অস্বস্তি

টানা প্রায় দুই বছরের অচলাবস্থার পর দেশের অর্থনীতি পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। যার প্রভাবে পরিবহন ভাড়া, কৃষি ও শিল্পসহ প্রায় সব ধরনের উৎপাদন খরচ বাড়তে শুরু করেছে। এদিকে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। বিশেষ করে দেড় বছরের ব্যবধানে চাল, ডাল, তেল, পিঁয়াজ, চিনিসহ শাক-সবজি ও মাছ-মাংসের মধ্যে কোনো কোনোটির দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এতে বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। যার ফলে গত কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতির চাপও ঊর্ধ্বমুখী।

অর্থবিভাগের সূত্রগুলো বলছে, করোনার মহামারীর কারণে রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় বাজেট ঘাটতি বাড়ার আশঙ্কা করছে সরকার। সেই আশঙ্কা থেকেই জ্বালানি তেলের ওপর ভর্তুকি না দিয়ে দাম সমন্বয় করে লোকসান ঠেকানোর চেষ্টা করছে সরকার। বিশ্ববাজারে প্রায় সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। বাড়ছেও। তাই দেশের বাজারেও ডিজেল, কেরোসিন, জেট ফুয়েলের দাম বাড়ানো হয়েছে। অবশ্য ডিজেলের দাম বৃদ্ধির বহুমুখী প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। বিশেষ করে এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কৃষি খাতে। ফলে সামনের সেচ মৌসুমে কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়বে। একইভাবে বাড়বে কৃষি পণ্যের দামও।

এদিকে রপ্তানি খাতের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। করোনা মহামারী দেশের রপ্তানি খাতকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। আবার ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। যার ফলে রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক সংক্রান্ত কিছু সুযোগ-সুবিধাও হারাবে বাংলাদেশ। যার প্রভাব এখন থেকেই পড়তে শুরু করেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বরেণ্য অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি কোনো একক পণ্যের দাম বৃদ্ধি নয়। শুধু পরিবহনই নয় এটার বহুমুখী প্রভাব রয়েছে এবং পুরোটাই নেতিবাচক প্রভাব। এতে কারখানার উৎপাদন খরচ বাড়বে। পরিবহন ভাড়া বাড়বে। বাসা বাড়িতে জেনারেটর চলে সেখানেও খরচ বাড়বে। বিশেষ করে কৃষি ক্ষেত্রে সেচ দিতে ডিজেলের প্রয়োজন হয়। কৃষকেরও উৎপাদন খরচ বাড়বে। আমরা তো এমনিতেই কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল দিতে পারি না। সেখানে খরচ আরও বাড়িয়ে দিলাম। আবার পণ্য পরিবহনেও খরচ বাড়বে। এমনকি সমুদ্র পথে জাহাজে পণ্য আসে সেখানেও খরচ বাড়বে। ফলে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরও ভাবা উচিত ছিল। এটা একটা অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত। এখনো সরকারের হাতে সময় আছে এটা পুনর্বিবেচনা করার মতো। অন্যথায় দেশের  অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে তিনি মনে করেন।

এদিকে করোনা মহামারীর প্রভাবে প্রায় ১৩ লাখ প্রবাসী দেশে ফিরে এসেছেন। যাদের বেশির ভাগই কাজে ফেরত যেতে পারেননি। আবার বাংলাদেশি শ্রমবাজার নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ফলে নতুন শ্রমিক পাঠানো কমছে ক্রমাগতভাবে। যার ফলে গত কয়েক মাস ধরে রেমিট্যান্স প্রবাহে বিরাজ করছে নেতিবাচক ধারা। যা দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্বস্তি সৃষ্টি করছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে টানা প্রায় দুই বছর ধরে চলছে করোনা মহামারী। এর আঘাতে গত বছরের শুরুতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে অর্থনীতি। সামষ্টিক অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই আবারও শুরু হয় করোনাভাইরাসের দ্বিতীয়, তৃতীয় ঢেউ। এতে একদিকে বিপুল সংখ্যক মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। অন্যদিকে অচল হয়ে যায় জীবন যাত্রা। একইভাবে দৈনন্দিন ব্যয়ের সঙ্গে বেড়ে যায় স্বাস্থ্য পরিচর্যার ব্যয়। এতে করোনায় হু হু করে বাড়তে থাকে জীবন যাত্রার ব্যয়। দিশাহারা হয়ে পড়েছে মানুষ। সরকারি খাতের সঙ্গে বেসরকারি খাতেরও উৎপাদন খরচ ও পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। যার ফলে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেই শুরু হয় অর্থনৈতিক টানাপোড়েন। যা শুধুই বাড়ছে। আবার দুশ্চিন্তা বাড়ছে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও বেকারত্ব নিয়ে। সূত্রমতে, গত দুই বছরে নতুন করে তেমন কোনো কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়নি। বরং কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। এ ছাড়া প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন আড়াই কোটি মানুষ। এদের বেশির ভাগই দিনের এক ভাগে প্রয়োজনের চেয়ে কম খাচ্ছেন। সরকারের হাতেও নেই প্রয়োজনীয় অর্থ। রাজস্ব আদায়ে তৈরি হয়েছে বিপুল পরিমাণ ঘাটতি। ফলে সরকারের ভিতরে ও বাইরে এবং মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে চলছে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন। কভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে নতুন বিশ্ব পরিস্থিতি কেমন হবে। সে সময় ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্প বিনিয়োগ কেমন হবে। সে সময়ের জন্য বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য নতুন নতুন অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের নতুন করে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধির তিন দিন পরই আবার পরিবহন ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এতে পক্ষান্তরে জনগণের কাঁধের বোঝা আরও বাড়ানো হয়েছে। করোনা মহামারীর কারণে মানুষের রোজগার এমনিতেই কমে গেছে। অনেকেই এখনো হারানো কাজও ফেরত পাননি। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। স্বাস্থ্য পরিচর্যার খরচ বাড়ায় মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও আগের বছরের তুলনায় অনেক বেশি। এরই মধ্যে পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধিতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি বাড়বে আবার সেই নিম্ন আয়ের মানুষেরই। যা দেশের অর্থনীতিতে অতিরিক্ত চাপ তৈরি করবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর