বুধবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মতিহারে চিরনিদ্রায় শায়িত হাসান আজিজুল হক

মর্তুজা নুর, রাবি

মতিহারে চিরনিদ্রায় শায়িত হাসান আজিজুল হক

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মতিহারের সবুজ চত্বরে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অগণিত ভক্ত-অনুরাগীর ভক্তি-ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে সমাহিত হন এই নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, গবেষক ও নন্দিত কথাসাহিত্যিক। ‘আগুনপাখি’র স্রষ্টা হাসান আজিজুল হক সোমবার রাত সোয়া ৯টায় রাজশাহীতে নিজ বাসভবন ‘উজান’-এ মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। ছোট গল্পের রাজপুত্র কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। ‘সকাল হোক, সূর্যের আলোর দিকে চেয়ে আবার উঠে দাঁড়াব আমি। একা।’ হাসান আজিজুল হক ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসে এভাবেই শুনিয়েছিলেন মানুষের অন্তহীন সংগ্রামের কথা, সীমাহীন সম্ভাবনা ও আশার কথা। সেই জীবন সংগ্রামী ও আশাবাদী হাসান আজিজুল হক ‘আগুনপাখি’র মতো আর কখনো ওঠে দাঁড়াবেন না, আর উড়াল দেবেন না। আর ‘উঁকি দিয়ে দিগন্ত’ দেখবেন না কীভাবে পোড়-খাওয়া ‘জীবন ঘষে আগুন’। দাফনের আগে বেলা ১১টায় দার্শনিক অধ্যাপক হাসান আজিজুল হকের মরদেহ ‘উজান’ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাঁর দীর্ঘকালের কর্মস্থল দর্শন বিভাগের মমতাজউদ্দিন কলাভবন প্রাঙ্গণে আনা হয়। সেখানে বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বেলা ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা জানান শিক্ষক, শিক্ষার্থী, লেখক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নেতাসহ সর্বস্তরের মানুষ। দুপুর দেড়টায় জোহরের নামাজ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অংশ নেন লেখকের হাজারো ভক্ত। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া ও অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার, মরহুমের ছেলে রাবির শিক্ষক ইমতিয়াজ হাসান মৌলি উপস্থিত ছিলেন। এই বরেণ্য কথাসাহিত্যিকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি গতকাল শোকবার্তা পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য মহলেও নেমে এসেছে শোকের ছায়া। শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে প্রয়াত লেখক-বুদ্ধিজীবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তারা বলেন, হাসান আজিজুল হক বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের জন্য এক হীরকখন্ড ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে যে শূন্যতা তৈরি হলো তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। তাঁর চেতনা ও মূল্যবোধ জাতির বিবেককে বহুকাল ধরে জাগ্রত রাখবে। তিনি সবার আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, হাসান আজিজুল হকের চলে যাওয়া এক বিশাল নক্ষত্রের পতন। তিনি বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে চিরজাগরূক থাকবেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক সাইদুর রহমান খান বলেন, এতবড় সাহিত্যিক হয়েও ব্যক্তিজীবনে খুবই সাদামাটা জীবনযাপন করতেন তিনি। তাঁর এ মৃত্যুর জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। হাসান আজিজুল হক ১৯৩৯ সালে অবিভক্ত বাংলার বর্ধমান জেলার যব গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের শিক্ষকতা শুরু করেন। ২০০৪ সালে প্রফেসর হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ অধ্যাপক ছিলেন। সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান। ১৯৯৯ সালে একুশে পদক এবং ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসের জন্য ২০০৮ সালে লাভ করেন কলকাতার ‘আনন্দ সাহিত্য পুরস্কার’।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক জানান : প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের মৃত্যুতে শিক্ষা ও সাহিত্য অঙ্গনে এক অপূরণীয় ক্ষতিসাধিত হলো বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। এক শোক বাণীতে উপাচার্য বলেন, হাসান আজিজুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ অধ্যাপক হিসেবে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। জনপ্রিয় এই কথাশিল্পীর মৃত্যুতে আমাদের শিক্ষা ও সাহিত্য অঙ্গনে এক অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হলো।

সর্বশেষ খবর