আত্মহত্যা একটি সামাজিক সমস্যা। সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও একে কখনো বায়োলজিক্যাল সমস্যা হিসেবে দেখা হয় না। এর সঙ্গে সব সময় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা জড়িত থাকে। আজকের বাংলাদেশে যে সামাজিক সমস্যা এবং পারিবারিক বন্ধন তা আগের থেকে অনেক বদলে গেছে। বিশেষত পরিবারগুলো একক পরিবার হয়ে গেছে। এক বা দুই সন্তান নিয়ে মা-বাবা থাকেন। অভিভাবকরাও কর্মব্যস্ত। কর্মব্যস্ত না থাকলেও পারিবারিক বন্ধনগুলো এখন অনেক শিথিল হয়ে গেছে। আত্মহত্যা মানুষ তখনই করে যখন সে মনে করে তার আর বাঁচার কোনো জায়গা নেই, সে একা হয়ে গেছে, জীবনের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না এবং তার সংগ্রামের যে ধারাবাহিকতা তা আর সে নিতে পারছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব বলেন।
জিনাত হুদা বলেন, বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীরা যেভাবে সমাজকে দেখে বাস্তবতা তা থেকে ভিন্ন। এ অবস্থায় কম বয়সীরা নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে মিল খুঁজে পায় না। আর এ ঘাটতি তাদের ওপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করে যা তারা নিতে পারে না। আবার কম বয়সী ছেলেমেয়েরা নিজেদের মনের কথা তাদের মা-বাবার সঙ্গেও ভাগাভাগি করতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, ইদানীংকালে ছোট ছোট ইস্যুতে কম বয়সীর আত্মহত্যার ঘটনা বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের চাহিদাগুলো এখন অনেক বেশি। আমাদের ভিতর এখন ভোগবাদী সংস্কৃতি এত বেশি ঢুকে গেছে যে ছেলেমেয়েরা অভিভাবকের কাছে কোনো কিছু আবদার করে না পেলেই ভাবে তাদের জীবন শেষ! বিশেষ করে যে পরিবারগুলোয় একটি সন্তান তাদের সামাজিকীকরণ এমনভাবে হয় যে তারা এককেন্দ্রিক হয়ে গড়ে ওঠে। নিজেকে নিয়েই তারা খুব ব্যস্ত থাকে, কিছু ভাগাভাগি করার মানসিকতা তাদের থাকে না। আমাদের নাগরিক জীবনের অনেক শিশু-কিশোরই কোনো কিছু ভাগাভাগি করে উপভোগ করার মানসিকতার সঙ্গে এখন আর পরিচিত নয়। আবার ব্যস্ততার কারণে অভিভাবকরাও সন্তান আবদার করা মাত্র কোনো কিছু চাইলেই তা কিনে দিয়ে তাকে শান্ত করাচ্ছেন। আর এ কারণগুলো কম বয়সীদের আত্মহত্যায় আরও প্ররোচিত করছে। অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, পরিবারকে শিশু-কিশোরদের সময় দিতে হবে। বাচ্চা কার সঙ্গে এবং কীভাবে মিশছে, কী চাচ্ছে এগুলো লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় এক ধরনের কাউন্সেলিং থাকা দরকার। সেখানে মনোবিজ্ঞানী থাকতে পারেন। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থী যদি অদ্ভুত আচরণ করে তাহলে মনোবিজ্ঞানীরা বিষয়টি দেখতে পারেন। এ ছাড়া আমাদের সাংস্কৃতিক বলয়টিকে আরও বৃদ্ধি করা উচিত। এতে একটি বাচ্চা তার ছোট চাহিদাগুলো ভুলে গিয়ে বৃহত্তর একটি সমাজের সঙ্গে নিজেকে অভিযোজন করতে পারলে তার মধ্য থেকে আত্মহত্যার চিন্তা সরে যাবে।