স্বর্ণ ব্যবসায়ী দিলীপের ছেলে আকাশের কোনো খোঁজ মিলছে না। নানির মৃত্যুর খবর শুনে ঢাকা থেকে সকালেই কুমিল্লার উদ্দেশে রওনা হন। গাড়িতে বসে তার বাবার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথাও হয়। কিন্তু সময়মতো না ফেরায় তাকে ফোন করেন তার বাবা। ফোন বন্ধ পান। সকালে রওনা দেওয়ার পর দুপুর গড়িয়ে বিকাল। আকাশ এ দীর্ঘ সময়েও কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে না পৌঁছানোয় সবার মধ্যে অস্বস্তি শুরু হয়। এমনিতেই পুরো বাড়িতে শোক চলছে। বাড়ির মুরব্বি মারা গেছেন। তাঁর সৎকার নিয়ে ব্যস্ত সবাই। এর মধ্যেই আকাশের কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকা থেকে কুমিল্লার সড়কপথের খোঁজখবর নিচ্ছেন দিলীপ। কোথাও কোনো যানবাহনের সমস্যা বা দুর্ঘটনা ঘটেছে কি না। কিন্তু খবর নিয়ে জানতে পারেন সড়কে কোনো যানজট নেই। কোথাও কোনো দুর্ঘটনাও ঘটেনি। ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন তিনি। কিন্তু আকাশের মায়ের কাছে এসব জানানো যাচ্ছে না। কারণ তিনি তার মাকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন। কান্নাকাটি করছেন। কষ্টের মধ্যে ছেলের না ফেরার বিষয়টি জানানো হলে হয়তো তার কোনো ক্ষতি হতে পারে। আকাশকে ছাড়াই নানির লাশের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। সবাই যে-যার মতো বাড়িতে ফিরছেন। কিন্তু দিলীপ তার সন্তানের খোঁজ পান না। তিনি মুখ চেপে ধরে ছেলের জন্য কান্না করতে থাকেন। ছেলেকে না পেয়ে ঢাকায় তার পরিচিত লোকজনকে বিষয়টি জানান। কুমিল্লায়ও খোঁজ নিতে শুরু করেন। কিন্তু খোঁজ নেই আকাশের। কয়েকজন আত্মীয়স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে সে রাতেই ঢাকায় রওনা হন দিলীপ। ভোরে তারা পৌঁছেন ভাটারায়। এখানেই একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন তার ছেলে ঢাকা ন্যাশনাল পলিটেকনিকের ছাত্র আকাশ। কিন্তু বাসায় তালা। দারোয়ানের কাছে তারা জানতে পারেন সকালেই আকাশ একটি মাইক্রোবাসে করে কুমিল্লার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। সঙ্গে তার দুই বন্ধুও। কিন্তু দারোয়ানের বিবরণ অনুযায়ী ছেলের সেই বন্ধুদের চিনতে পারেননি দিলীপ। অজানা এক আশঙ্কায় ভুগতে থাকেন। দিনভর হাসপাতাল, থানা পুলিশ এমনকি মর্গে পর্যন্তখোঁজ করেন কিন্তু আকাশকে খুঁজে পান না। দিলীপ ফিরে যান কুমিল্লার বাড়ি। ততক্ষণে বাড়ির সবাই জানতে পেরেছেন আকাশকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আকাশের নানির মৃত্যুতে তার মায়ের মানসিক অবস্থা নাজুক। তার মধ্যে আকাশের নিখোঁজ সংবাদে আরও ভেঙে পড়েন। পুরো বাড়িতে যেন এক ঝড় বয়ে চলেছে। বাড়ির প্রতিটি ঘরে তখন কান্নার রোল।

মধ্যরাতে দিলীপের কাছে ফোন আসে। অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি ফোনে বলেন, ‘আপনার ছেলে আকাশ আমাদের কাছে আছে। প্রাণসহ ফেরত নিতে হলে ৩০ লাখ টাকা দিতে হবে। অন্যথায় আপনার ছেলের লাশও পাবেন না। আপনার ছেলেকে আমরা ধরেছি উলঙ্গ অবস্থায় একটি মেয়ের সঙ্গে। তাদের ছবিও আছে। কিন্তু বাবা হিসেবে আপনাকে দেখানোটা ঠিক হবে কি না আমরা ভেবে দেখি।’ এ কথা বলেই লাইন কেটে দেন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিটি। দিলীপ ভয় পেলেও নিশ্চিন্ত বোধ করছেন। ছেলের সংবাদ তো পাওয়া গেল! ভোরের দিকে আবারও ফোন আসে। ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দেবে কি না জানতে চায় দুর্বৃত্তরা। দিলীপ জানতে চান টাকা নিয়ে কোথায় যাবেন। কিন্তু সে জায়গার নাম আর বলে না তারা। এমন করতে করতেই দিন কাটতে থাকে। পাগলের মতো হয়ে পড়েন দিলীপ। সাত দিনের মাথায় পুলিশকে জানানো হয়। পুলিশ মাঠে নামে। দুর্বৃত্তদের ফোন নম্বরের লোকেশন জেনে অভিযান চালায়। কিন্তু দুর্বৃত্তরা এতটাই চতুর যে তারা এক স্থানে থাকছিল না। ঢাকা ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে জায়গা বদল করছিল। পুলিশ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর, কুমিল্লার মুরাদনগর ও কোম্পানীগঞ্জ, গাজীপুরের জয়দেবপুর, রাজধানীর দক্ষিণখান, উত্তরখান, খিলক্ষেত ও ভাটারায় একে একে অভিযান চালায়। ফোনের নম্বরের সূত্র ধরে পুলিশ নিশ্চিত হতে পারে তাদের পরিচয়। ১৫ দিন পেরিয়ে যায়। পুলিশ ধরতে পারে না অপহরণকারীদের। উদ্ধার হন না আকাশ। গোয়েন্দা পুলিশ সোহেল নামে একজনকে সন্দেহ করে। তাকে গ্রেফতারের জন্য দক্ষিণখানের বাসায় হানা দেয়। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি বলে পুলিশ তার বাবা-মাকে গোয়েন্দা দফতরে নিয়ে যায়। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ধরা পড়েন সোহেল। সোহেলের কাছ থেকে আকাশের অবস্থান জানতে পারে পুলিশ। দক্ষিণখানের একটি বাসা থেকে উদ্ধার হন আকাশ। সেই সঙ্গে গ্রেফতার করা হয় জুয়েল রানা ও ইয়াসিন নামে অন্য দুই অপহরণকারীকে। পুলিশ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। জেরার মুখে পুলিশ জানতে পারে ভয়ংকর তথ্য। যা জেনে পুলিশও হতবাক। অপহরণের তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে একাধিক খুনিচক্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সক্রিয়। তারা টার্গেট করে সম্পর্ক গড়ে তোলে। সুযোগমতো অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায় করে। টাকা না পেলে নারীদের সঙ্গে ছবি ও ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়। এতেও টাকা না মিললে হত্যার মতো ঘটনা ঘটায়। তারা ফেসবুককে তাদের অপরাধের একটি বড় প্ল্যাটফরম হিসেবেই মনে করে। জানতে চাইলে ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ডিভিশনের উপ-কমিশনার (ডিসি) আলিমুজ্জামান বলেন, ‘সাইবার অপরাধ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সামাজিকভাবে এটা প্রতিরোধ করতে এখনই এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। না হলে ক্ষতিটাই বেশি হবে। এতে সে নিজে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমন তার বাবা-মা ও পরিবারের লোকজনকে বিপদে ফেলছে। আর ফেসবুকের ব্যবহারকারীদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। খোঁজখবর না নিয়ে কারও সঙ্গেই সম্পর্কটাকে ঘনিষ্ঠ পর্যায়ে নেওয়া ঠিক না।’