মঙ্গলবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ব্রিটেনজুড়েই বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি

মাহমুদ আজহার, লন্ডন থেকে

ব্রিটেনজুড়েই বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি

পূর্ব লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেলের একটি শপিং মলে ‘সেলসম্যান’ হিসেবে কাজ করেন কামাল আহমেদ নামে এক তরুণ। সম্প্রতি ওই সুপারমলে দেখা হয় তার সঙ্গে। এ সময় দেখা যায়, তিনি বাংলার পাশাপাশি অনর্গল ইংরেজি, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন। ক্রেতাদের নানা পণ্যে দৃষ্টি আকর্ষণ করাচ্ছেন। তার এমন প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় দক্ষিণ এশিয়ার পাশাপাশি ইংরেজ ক্রেতারাও খুশিতে কেনাকাটা করছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি জানালেন, ইতালি থেকে বেশ কিছুদিন আগে তিনি লন্ডনে এসেছেন। ইতালীয় ভাষা ছাড়াও বেশ কয়েকটি ভাষায় তিনি কথা বলতে পারেন। তবে সবচেয়ে প্রিয় ভাষা বাংলা। ভাষার কারণে কোনো ক্রেতাকেই তার কাছ থেকে ফেরত যেতে হয় না। এতে শপিং মল কর্তৃপক্ষও তার ওপর খুশি। শুধু কামাল আহমেদই নন, গ্রেট ব্রিটেনজুড়েই বসবাস করা লাখ লাখ বাংলাদেশি নানা পেশায় যুক্ত। বড় বড় পোশাকের দোকানে লেখা ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ দেখে গর্বে মন ভরে যায়। বাংলাদেশি নিত্যপণ্যের নানা সামগ্রীর দেখা মেলে বিভিন্ন সুপারশপে। দোকানপাট, রাস্তা ও অলিগলিতে বাংলা হরফে লেখার ছড়াছড়ি। এ ছাড়া ব্রিটেনজুড়েই রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন সুপারমল, গ্রোসারিস শপ, অনলাইন বিজনেস, ইলেকট্রিক ব্যবসা, হাউজিং ব্যবসা, কেয়ার (নার্সিং) হোম, ফটোকপি, বিকাশ, মানি এক্সচেঞ্জ, ট্যাক্সিড্রাইভার, মসজিদ-মাদরাসাসহ ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠানে কমবেশি দেখা মেলে বাংলাদেশিদের। গ্রেট ব্রিটেনের চারটি প্রদেশের এমন কোনো শহর নেই, যেখানে নেই বাংলাদেশি। মনে হয়, পুরো গ্রেট ব্রিটেনই যেন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।

স্কটিশ পার্লামেন্টে প্রথম বাংলাদেশি মেম্বার ফয়সল আহমেদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিশে^র প্রায় সব দেশেই বাংলাদেশি মানুষের বিচরণ। এটা খুবই আনন্দের। তবে গ্রেট ব্রিটেনে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করছে। তারা সবাই রেমিট্যান্স যোদ্ধা। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ব্রিটেন প্রবাসীদের বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। প্রিয় মাতৃভূমির কল্যাণের জন্য সবারই যার যার অঙ্গন থেকে সহযোগিতা করা উচিত বলে আমি মনে করি।’

গ্রেট ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের বসবাস করা বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে- লন্ডন সিটির ব্রিকলেন, হোয়াইট চ্যাপল, অল গেট, বো, মাইল্যান্ড, বেতনাল গ্রিন, গ্রিন স্ট্রিট, স্টেফনি গ্রিন, ওয়েস্ট হাম, বো চার্জ, বোমলি বাইব, হেকনি, অল গেট ইস্ট, ব্রাইটন সিটি, লোটন সিটি, ব্যাডফোর্ড, ব্রাইটোল, এসেক্স, ক্রয়ডন, রিচমল, মাউথপৌস, সাউথ আমটন, বেল্ট, মিলটন কিংস, পিটাবরা, বার্মিংহামের স্মল হিথ, অসল, ওয়েস্ট মিডল্যান্ড, ম্যাঞ্চেস্টার সিটি, হালি ফ্যাক্স, সেফিল্ড, ওয়েক ফিল্ড, ওলডাম, রোসডেল, বার্রনলি, লেস্টার সিটি, নর্থাস্টন সিটি, ব্র্যাটফোর্ড, লিডস, বিস্টন, ইয়ক, হারো গেট, ওয়েদার বি, সিপলি, স্কান্তফ, গ্রিনস বি, হিচিং, ডংকাস্টার, সান্ডারল্যান্ড, নিউ ক্যাসল, সাউথশিল, ডালিংটোন, ডারাম, স্কাবরা, ব্রিস্টল, কার্ডিফ, সোহানসি, স্কটল্যান্ডের এডামবরা, গ্লাসগো, এবাডিন সিটি, লিবারপুল, সুইনডন, অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, ইপসুইট, নর্দান আয়ারল্যান্ডের বেল ফাস্ট, চেস্টার প্রভৃতি। ব্রিটেনে বসবাসরত প্রবাসীরা বলছেন, দেশটির সরকারি বেসরকারি উচ্চ পর্যায়ে বাংলাদেশির সংখ্যা কম। দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় কম বাংলাদেশিই শীর্ষ পর্যায়ে অবস্থান করছেন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পর্যাপ্ত দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। তাছাড়া স্টুডেন্ট ভিসায় যারা আসেন তাদের বড় একটি অংশই দক্ষ হওয়ার আগেই কর্মক্ষেত্রে জড়িয়ে পড়ছেন। রেস্টুরেন্ট পরিচালনার দক্ষ লোকেরও যথেষ্ট অভাব আছে। এ ব্যবসা নিয়ে পড়াশোনা নয়, শুধু কাজ করা থেকেই শিখছেন প্রবাসীরা। এ কারণে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশি মানুষের খাবার সামগ্রীই দেখা মেলে প্রবাসীদের রেস্টুরেন্টে। বিশে^র রাষ্ট্রগুলোর মানুষের খাবার মেন্যু কিঞ্চিৎই পাওয়া যায় বাংলাদেশি নেতৃত্বাধীন রেস্টুরেন্টগুলোতে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রেট ব্রিটেনে বাংলাদেশি মালিকানাধীন ১৬ হাজার রেস্টুরেন্টে অন্তত ৭০ হাজারের বেশি প্রবাসী বাঙালি কর্মরত রয়েছেন। এ ছাড়া ৬ লাখের মতো বাংলাদেশি সপরিবারে বসবাস করছেন। শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে প্রায় ৩৫ হাজার ছাত্র-ছাত্রী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। বাংলাদেশি নেতৃত্বাধীন মসজিদে ইমাম ও মোয়াজ্জিন রয়েছেন আড়াই শতাধিক। আছে মাদরাসাসহ বেশ কিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও। অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যও করছেন কেউ কেউ। তবে করোনা-পরবর্তীতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় ধস নেমেছে বলে জানা গেছে। ওয়ার্ক পারমিট না পাওয়ায় বাংলাদেশিরা ব্রিটেনে আসার সুযোগ পাচ্ছেন না। লন্ডনে আইন পেশায় যুক্ত ব্যারিস্টার ইসলাম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে গ্রেট ব্রিটেনে। এরমধ্যে বিশাল একটি জনগোষ্ঠী বাংলাদেশি। এটা সত্যিই আমাদের জন্য গর্বের। আমি মনে করি, আমরা যদি কর্মক্ষেত্রে আরও যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দিতে পারি, তাহলে বাংলাদেশিরাই এক দিন পুরো ব্রিটেনের নেতৃত্ব দেবে ইনশাআল্লাহ।’ লিডস এ সাংবাদিকতায় যুক্ত মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, ‘গ্রেট ব্রিটেনের বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশিদের কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। এ জন্য পর্যাপ্ত ওয়ার্ক পারমিট জরুরি। ব্রিটেনের সংশ্লিষ্ট সেক্টরগুলোতে বাংলাদেশি যোগ্য ও দক্ষ কর্মী প্রয়োজন। সে বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকেও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’ বার্মিংহামে বসবাসরত শিক্ষাবিদ উবায়দুল হাসান লোদী বলেন, ‘গণতন্ত্রের সূতিকাগার গ্রেট ব্রিটেনে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি বিভিন্ন পেশায় যুক্ত। এমন কোনো শহর নেই যেখানে কমবেশি বাংলাদেশি নেই। বাংলা ভাষায় লেখা বিভিন্ন শপে সাইনবোর্ডও শোভা পায়। এটা সত্যিই আমাদের জন্য গর্বের।’

সর্বশেষ খবর