মঙ্গলবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

নারী পাচারের রুট দুবাই

টার্গেট ১৮ থেকে ২৪ বছর, বাধ্য করা হয় দেহব্যবসায়, আটক ১

নিজস্ব প্রতিবেদক

পাচারকারীদের টার্গেট ১৮ থেকে ২৪ বছরের সুন্দরী নারী। প্রতি মাসে বেতন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। কর্মস্থল দুবাইয়ের ড্যান্স ক্লাব। যেতে কোনো টাকা নেওয়া হয় না। প্রতারক চক্রের এমন লোভনীয় প্রস্তাবের ফাঁদে পা দিয়ে পড়েছেন মহাসংকটে। তাদের প্রায় সবাইকেই দেহব্যবসায় বাধ্য করছে আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্র। অন্যদিকে পুরুষদেরও এমন লোভনীয় চাকরির প্রস্তাব দিয়ে নেওয়া হতো সাড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা। তবে দিনের পর দিন তাদের ঘুরিয়ে আসছিল প্রতারক চক্র। টাকা চাইতে গেলে দেওয়া হতো প্রাণনাশের হুমকি। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গতকাল দুপুরে রাজধানীর পল্টন থেকে এ চক্রের অন্যতম হোতা শামসুদ্দিনকে (৬১) আটক করেছে র‌্যাব-১-এর একটি দল। এ সময় তার কাছ থেকে দুটি মোবাইল ফোন, একাধিক ব্যক্তির পাসপোর্ট, একটি বিএমইটি কার্ড এবং এক নারী ও তিন পুরুষ ভিকটিমকে উদ্ধার করা হয়। গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন। ব্রিফিংয়ের পর এক ভুক্তভোগী জসিমের সঙ্গে কথা বলেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তার বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছায়। কথা বলার একপর্যায়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন জসিম। গণমাধ্যমকর্মীর অনেকেই এ সময় চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। দিনমজুর এই ব্যক্তি সুদের ওপর সাড়ে ৪ লাখ টাকা দিয়েছেন এ চক্রকে। ছয় মাস ধরে তাকে দুবাই পাঠানোর কথা বলে ঘোরানো হচ্ছিল। ক্রমেই বাড়ছে তার ঋণের বোঝা। লে. কর্নেল মোমেন বলেন, পাচারকারী চক্রটি  ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছাড়াই জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) নকল কার্ড তৈরি করত। তার মোবাইল ফোন থেকেই ৮২টি পাসপোর্টের ছবি পাওয়া গেছে। এদের তারা বিভিন্ন সময় দুবাই, মালয়েশিয়া এবং ভারতে পাচার করেছে। গার্মেন্ট কর্মী হিসেবে কার্ড তৈরি করা হলেও তাদের বেশির ভাগকেই দুবাইয়ে পাচার করে আসছিল চক্রটি।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের এজেন্ট রয়েছে উল্লেখ করে লে. কর্নেল মোমেন বলেন, পাচারকারীরা বিদেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সহজ সরল মানুষকে ফাঁদে ফেলে দুবাইয়ে নিয়ে যেত। তাদের পাতা জালে জড়িয়ে অবৈধ পথে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে সাধারণ মানুষ। যার অধিকাংশই নারী। এসব নারীকে বিদেশে বিভিন্ন পেশায় লোভনীয় ও আকর্ষণীয় বেতনে চাকরির কথা বলে বিক্রি করে দিত। পরে জোরপূর্বক ডিজে পার্টি, দেহব্যবসাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়ানো হতো। সম্প্রতি মানব পাচারকারী চক্রের বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রাখে র‌্যাব।

গ্রেফতার শামসুদ্দিনের দেওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে আল মোমেন জানান, বর্তমানে দুবাই অবস্থানরত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দীনের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে তারা এ চক্রের সঙ্গে কাজ করত। জিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তির যোগসাজশের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন কোম্পানি ও গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারক চক্র মেয়েদের বিদেশে যেতে প্রলুব্ধ করে। কোনো তরুণী বিদেশ যেতে রাজি না হলে নানা হুমকি দেওয়া হতো। তা ছাড়া এ চক্রটি বিদেশ যেতে ইচ্ছুক অনেক পুরুষের কাছ থেকে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছে।

র‌্যাব-১-এর অধিনায়ক বলেন, সম্প্রতি জিয়া চক্রের মাধ্যমে বিমানবন্দর দিয়ে কয়েকজন নারী পাচার করা হচ্ছে- এমন খবরে আমরা তাদের উদ্ধার করি। গতকাল তথ্য পেলাম জিয়া চক্রটি আবারও এক নারীকে পাচারের চেষ্টা করছে। এরপর অভিযান চালিয়ে ওই নারী ও তিন পুরুষকে উদ্ধার করা হয়। এই জিয়ার বিভিন্ন এলাকায় নেটওয়ার্ক রয়েছে। তারা প্রথমে অল্পবয়সী নারীদের টার্গেট করে। এরপর বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের ঢাকায় এনে হোটেলে রেখে পাসপোর্ট ও বিএমইটি কার্ড তৈরি করে দেয়। এ ছাড়া বিদেশ যেতে করোনা পরীক্ষার সার্টিফিকেটও করে দিত। এর পরই নারীদের বিদেশে পাচার করে দেওয়া হতো। চক্রটি দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া পাচার করত। পাচারকারী চক্র অতি কৌশলে নকল বিএমইটি কার্ড তৈরি করে নারীদের পাচার অব্যাহত রেখেছে। পাচার করতে যাওয়া একজন নারীকে দেশে থাকা অবস্থায় ৩০ হাজার টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়। তাকে আরও টাকা দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করা হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর