শনিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

সমুদ্রসৈকতগুলোয় উপচে পড়া ভিড়, নেই থাকার জায়গা

তিন দিনের ছুটির ফাঁদ

প্রতিদিন ডেস্ক

সমুদ্রসৈকতগুলোয় উপচে পড়া ভিড়, নেই থাকার জায়গা

কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে পর্যটকের ভিড় -বাংলাদেশ প্রতিদিন

টানা তিন দিনের ছুটির ফাঁকে দেশের সমুদ্র সৈকতগুলোয় পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় জমেছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে হাজার হাজার ভ্রমণ পিয়াসীর উপস্থিতিতে প্রতিটি সৈকতগুলো জমে উঠেছে। বৃহস্পতিবার বিজয় দিবস এবং পরের দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি মিলে এ অবস্থা চলছে। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

কক্সবাজার : বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সৈকতে পর্যটকের তিল ধারণের ঠাঁই নেই। পর্যটন ব্যবসায়ীদের ধারণা, প্রায় ৫ লাখের মতো পর্যটকের সমাগম ঘটেছে। আগের দিনের মতো গতকাল বিকালেও কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের শৈবাল পয়েন্ট থেকে কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা ছিল লোকারণ্য। কেউ ঘুরে বেড়িয়েছেন বিস্তীর্ণ  সৈকতের বালিয়াড়িতে; ঘোড়ায় চড়েছেন, বালিয়াড়িতে আলপনা এঁকেছেন। অনেক পর্যটককে ছাতার নিচে বসে সাগরের হাওয়ায় গা ভাসাতে দেখা গেছে। অনেকে মোবাইল ফোনে আনন্দের এ মুহূর্তকে ফ্রেমবন্দী করেছেন। অনেকেই সাগরজলে ঢেউয়ের তালে তাল মিলিয়েছেন। শিশুদেরও দেখা গেছে  বাবা-মায়ের সঙ্গে জলকেলিতে। এদিকে পর্যটকদের জায়গা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হোটেল-মোটেলগুলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজারে পর্যটকের এই স্রোত গতকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান জানান, টানা ছুটির প্রথম দিন বৃহস্পতিবারই বিপুল সংখ্যক পর্যটক এসেছেন। কক্সবাজারের সাড়ে ৪ শতাধিক হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউস-কটেজের ৯৫ শতাংশের বেশি কক্ষ আগাম বুকিং হয়ে যায়। আগে আসা পর্যটকদের কক্ষ ছেড়ে দেওয়ার পরপরই বুকিং হয়ে গেছে। নতুন করে আসা পর্যটকদের কক্ষ দিতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার হোটেল, মোটেল, জোন, বিচ এলাকা, ইনানিসহ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বিভিন্ন স্থানে যে চার শতাধিক রেস্টুরেন্ট রয়েছে এর মধ্যে বেশির ভাগ রেস্টুরেন্টে চলছে গলাকাটা বাণিজ্য।

রাঙামাটি : লাখো পর্যটকের ভিড়ে মুখর পাহাড়। টানা তিন দিনের সরকারি ছুটিকে কাজে লাগাতে ভ্রমণ পিয়াসীরা ছুটছেন পাহাড়ে। প্রতিদিন আসছেন দুই থেকে চার হাজারেরও অধিক মানুষ। গতকাল লাখো মানুষের জনসমুদ্রে পরিণত হয় পাহাড়। শুধু রাঙামাটি নয়, এমন পর্যটক উৎসবে মেতেছে অপর দুই পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। সবুজ অরণ্যের রাজ্য পার্বত্যাঞ্চলে পুরোদমে শুরু হয়েছে পর্যটন মৌসুম। বইছে পর্যটক উৎসবের আমেজ। পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত পাহাড়ের পর্যটন কেন্দ্রগুলো। অগণিত পর্যটক আগমনে তিল পরিমাণ জায়গা খালি নেই কোথাও। সরেজমিন দেখা গেছে, গতকাল বিকালে রাঙামাটির পর্যটন কেন্দ্রগুলো ছিল লোকে লোকারণ্য। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে আগত পর্যটকরা রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু, শুভলং ঝরনা, পলওয়েল পার্ক, ডিসি বাংলো পার্ক ও কাপ্তাই-আসামবস্তি সড়কসহ বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ কাপ্তাই হ্রদ নৌ-ভ্রমণের আনন্দ উচ্ছ্বাসে মেতেছে।

বান্দরবান : পার্বত্য জেলা বান্দরবানের বিভিন্ন স্পটে হাজার হাজার পর্যটকের ভিড়ে সরগরম হয়ে উঠেছে। খালি নেই হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট, সরকারি, বেসরকারি, এনজিওসহ কোনো গেস্ট হাউসও। গতকাল সকালে বান্দরবান বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে যাওয়া-আসার কোনো বাস-কোচেই টিকিট নেই। পর্যটক বহনকারী বান্দরবান জিপ-মাইক্রোবাস-চাঁদের গাড়ির সব বুকিং সকাল ৮টার মধ্যেই শেষ হয়ে যাওয়ায় রুমা, থানচি, বগা লেক, দেবতাকুম, আমিয়াখুম, ডিম পাহাড়, তিন্দু, রেমাক্রী এবং তমাতুঙ্গীসহ বিভিন্ন আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট দেখতে আসা পর্যটকরা গাড়ি না পেয়ে ক্ষোভে বুকিং কাউন্টার ঘিরে রেখেছেন।

দুপুরে বান্দরবান শহরের কাছে রুপালী ঝরনা স্পটে গিয়ে দেখা গেছে, ডিজেলচালিত মাহিন্দ্র ট্যাক্সি, সিএনজিচালিত ট্যাক্সি এবং অন্যান্য যানবাহন নিয়ে ৭০০-৮০০ মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছেন। শীত মৌসুম আসায় এই জলপ্রপাতে পানির বেগ কমে আসলেও গাড়ির অভাবে দূরে যেতে না পেরে এখানে এসে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হচ্ছে বলে কয়েকজন পর্যটক জানিয়েছেন।

বিনিয়োগাকারীদের দৃষ্টি কুয়াকাটায় : বদলে গেছে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের বেলাভূমি সাগরকন্যা কুয়াকাটার চিত্র। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষ করে পায়রা সেতু চালু হওয়ায় প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে পর্যটকদের আগমন। আগামী বছর চালু হবে পদ্মা সেতু। এর ফলে বিনিযোগকারীরাও আসতে শুরু করেছেন। এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে পাঁচ তারকা মানের আবাসিক হোটেল মোটেল ও রিসোর্ট। ছোট বড় মিলিয়ে কুয়াকাটায় প্রায় দুই শতাধিক আবাসিক হোটেল মোটেল রয়েছে। এখানে রয়েছে সরকারি বিভিন্ন দফতরের বাংলো। এ ছাড়া গড়ে উঠেছে উন্নতমানের খাবার হোটেল ও রেস্তোরাঁ। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন কুয়াকাটা পর্যটন নগরী বিদেশি পর্যটকদের কাছেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, মহান বিজয় দিবসসহ তিন দিনের ছুটিতে আগমন ঘটেছে হাজারো পর্যটকের। কুয়াকাটার জিরো পয়েন্ট, লেম্বুর চর, ঝাউবাগান, গঙ্গামতির লেক, কাউয়ার চর, মিশ্রিপাড়া, শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ বিহার, রাখাইন তাঁতপল্লী এবং শুঁটকি পল্লীসহ দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্পটগুলোয় এখন আগত দর্শনার্থীদের সরব উপস্থিতি। এদিকে টানা তিন দিনের ছুটিতে আগেভাগেই অধিকাংশ হোটেল-মোটেলগুলোর রুম বুকিং হয়ে গেছে। বছরের বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে এমন পর্যটকদের আগমন ঘটে। আর এ রেকর্ড সংখ্যক পর্যটকের আগমনে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও এখন বেজায় খুশি। এর ফলে করোনার সময়ের কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবে বলে পর্যটন-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।

সমুদ্র বাড়ি রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরুল ইসলাম মিরন বলেন, আগেই আমাদের সব রুম বুকিং রয়েছে। আগামী ১৬ থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সব কক্ষ অগ্রিম বুকিং দেওয়া রয়েছে।

ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটা টোয়াক সভাপতি রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হাওয়ায় এখন পর্যটকদের আগমন বেড়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে কুয়াকাটা হবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। এরই মধ্যে অনেক বিনিয়োগকারী বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করছেন।

কুয়াকাটা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি এ এম মিজানুর রহমান বুলেট বলেন, পায়রা সেতুটি চালু হওয়ায় পর্যটকরা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে কুয়াকাটায় আসতে পারছে। এখন সারা সপ্তাহজুড়ে কুয়াকাটায় পর্যটক থাকে। কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র আনোয়ার হাওলাদার বলেন, বিজয় দিবস ও সরকারি তিন দিনের ছুটিতে কুয়াকাটায় অনেক পর্যটক এসেছে। তবে পর্যটকরা যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরতে পারে এবং কোনো ধরনের প্রতারণার শিকার কেউ না হয় সে জন্য কুয়াকাটা পৌরসভার টিম সার্বক্ষণিক তদারকি করছে।

সিলেট : এবার বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে পর্যটক সমাগম বেশি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ঠাসা পর্যটকে হাসি ফুটেছে এ-খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মুখে। করোনার ধাক্কা পেরিয়ে দীর্ঘদিন পর পর্যটক সমাগম বেশি হওয়ায় ‘ঈদ আনন্দ’ বোধ করছেন তারা।

সিলেট শহর ও শহরতলির কয়েকটি পর্যটন কেন্দ্র ও পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় স্থান ঘুরে বিপুল সংখ্যক পর্যটকের আনাগোনা দেখা গেছে। সিলেটের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা জাফলং, লালাখাল, শ্রীপুর, বিছানাকান্দি, রাতারগুল, ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকায় এখন হাজার হাজার পর্যটক। সিলেটে যত পর্যটক আসেন, তিনি যে ধর্মাবলম্বীরই হোন না কেন, অন্তত একবার হযরত শাহজালাল (রহ.) ও শাহপরাণ (রহ.) এর মাজারে ঢুঁ মারার চেষ্টা করেন। গতকাল সকালে মাজারে গিয়ে শত শত পর্যটকের দেখা মেলে। পুরো দিনকে কাজে লাগাতে সকালে মাজার ঘুরে অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রে ছুটছিলেন তারা।

শ্রীমঙ্গল : দেশি-বিদেশি পর্যটকে মুখরিত হয়ে উঠেছে পর্যটন শহর শ্রীমঙ্গল। টানা তিন দিন ছুটি কাটাতে পর্যটকরা ছুটে এসেছেন এখানে। এদিকে পর্যটকদের অতিরিক্ত চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন হোটেল রিসোর্ট মালিকরা। অধিকাংশ হোটেল রিসোর্ট ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বুক হয়ে আছে। হোটেল রিসোর্টে সিট না পেয়ে গত বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত পর্যটকদের শহরের খাবার হোটেলে বসে থাকতে দেখা যায়। কেউ রাস্তায় হেঁটে হেঁটে রাত কাটিয়ে দেন। তাদের কেউ আসেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। কেউ কেউ আসেন একত্রে বাস ভাড়া করে। এসেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। পর্যটকরা গতকাল চা-বাগান, নীলকণ্ঠ চা কেবিন, বধ্যভূমি ৭১, বিটিআরআই চা গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন, বাইক্কাবিল ও কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ঘুরে বেড়ান। পর্যটকরা ভোরে বেরিয়ে পড়েন চা-বাগানের পথ ধরে। মুগ্ধ হন ভোরের শিশির ভেজা চা-বাগান দেখে। কেউ চলে যান হাইল হাওরের বাইক্কা বিলে অতিথি পাখির কলবর শুনতে। কেউ চলে যান লাউয়াছড়া সবুজ অরণ্যে। আবার নীলকণ্ঠে সাত কালারের চা কেবিনেও জটলা দেখা যায় পর্যটকদের। এখানে চা পান করেই পর্যটকরা ঘুরতে যান পাশের রামনগর মণিপুরী পল্লীতে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর