মঙ্গলবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

পরিবারেই অনিরাপদ আপনজন

♦ বেড়েছে মাদকাসক্তি কলহ পরকীয়া সন্দেহ যৌতুক দাবির ঘটনা ♦ হত্যাকান্ড বেড়েছে মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণেও

জিন্নাতুন নূর

পরিবারের মধ্যে এখন আপনজনরাও আর নিরাপদে নেই। যে শিশুর মা-বাবার আদরযত্নে বড় হয়ে ওঠার কথা, সেই মা-বাবাই এখন নিজ সন্তানকে নির্দয়ভাবে হত্যা করছেন। জন্মদাতা মা-বাবাকেও স্বার্থ হাসিলের জন্য নির্মমভাবে হত্যা করছে আপন সন্তান।

বিভিন্ন কেস স্টাডি থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পারিবারিক কলহ, পরকীয়া, সম্পর্কে সন্দেহ, যৌতুক, মাদকাসক্তি এবং মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে এখন অনেক পরিবারেই এ ধরনের ভয়াবহ সহিংসতা ঘটছে।

অপরাধবিজ্ঞানীরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, একটি সন্তান যখন দেখে তার মা-বাবা নেতিবাচক সম্পর্কের মধ্যে আছে তখন এ ধরনের সহিংসতা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে চলে যায়। ফলে এই শিশুরাও একসময় অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। ব্যস্ততার কারণে পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ এখন কমে এসেছে। এ ধরনের সামাজিক ও পারিবারিক অস্থিরতা একটা বড় সময় ধরে আমাদের বহন করতে হবে। কিন্তু এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের স্কুলগুলোয় যে পর্যাপ্ত সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করার কথা আমরা তা করতে পারিনি। পরিবারের ভিতর এখনো আমরা কোয়ালিটি টাইম কাটাতে পারছি না। সুতরাং সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার সম্পর্ক আরও জোরদার করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন, ‘এ মহামারীতে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা ও উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষ সামান্যতেই এখন খিটখিটে হয়ে পড়ছে। সব মিলিয়ে তারা এক ধরনের অনিরাপত্তায় ভুগছে। মানুষ এখন শারীরিক নিরাপত্তার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তার অভাবও বোধ করছে। দেখা যাচ্ছে যেসব স্ত্রী সব সময় চুপচাপ ছিলেন তারাও এখন হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন। আবার যে স্বামী সব সময় ভদ্র আচরণ করতেন বিভিন্ন মানসিক চাপে পড়ে তারাও এখন সামান্যতেই উত্তেজিত হয়ে উঠছেন।’ সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি পারিবারিক সহিংসতার মধ্যে একটি ঘটেছে কুড়িগ্রামের রৌমারীতে। সেখানে পারিবারিক কলহের জেরে আট মাস বয়সী সন্তান ও স্বামীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে শারমিন খাতুন নামে এক গৃহবধূকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘটনার কয়েকদিন আগে শারমিন ও তার স্বামী সোহেল রানার মধ্যে পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হয়। এর জেরে শারমিন তার সন্তানকে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। শিশুটিকে বাঁচাতে গেলে সোহেল রানাকেও এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন।

ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে নরসিংদীর চিনিশপুর ইউনিয়নে পারিবারিক বিরোধের জেরে স্ত্রী রেশমী আক্তার (২৬) ও দেড় বছরের সন্তান সালমান সাফায়াতকে গলা কেটে হত্যা করেন ফখরুল মিয়া। জানা গেছে, দুই বছর আগে এ দম্পতির বিয়ে হয়। কয়েক মাস পরই স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন রেশমীর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করেন। রেশমীর স্বজনরা জানান, ফখরুল মাদকাসক্ত ছিলেন। বরগুনার আমতলী উপজেলায় পারিবারিক দ্বন্দের জেরে ছয় মাস বয়সী ছেলেকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে বাবা বিপ্লব পেয়াদারের বিরুদ্ধে। শিশুটির মা কুলসুম জানান, পারিবারিক বিষয়ে স্বামীর সঙ্গে দ্ধন্ধ হলে তিনি তার শিশু সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যান। এর মধ্যে বিপ্লব ছেলেকে তার কাছ নিয়ে গিয়ে হত্যা করে গোপনে তার ঘরের বারান্দায় রেখে যান।

এ ছাড়া বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বড় দুলালী গ্রামে পলি বেগম (৩৫) নামে এক নারী তার তিন মাস বয়সী সন্তানকে হত্যা করেন। পলি গ্রামের সাগির তালুকদারের স্ত্রী। মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত পলির সন্তান সংখ্যা বেশি হওয়ায় শিশুপুত্র জুবায়ের তালুকদারকে গলা টিপে ও বালতির পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেন।

গাজীপুর মহানগরের পশ্চিম জয়দেবপুর মুক্তারটেক এলাকায় মানসিক ভারসাম্যহীন লিজা বেগম তার চার বছর বয়সী ছেলে ও সাত মাস বয়সী মেয়েকে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। নভেম্বরের মাঝামাঝি নেশার টাকা না পেয়ে তিন সন্তানকে বিষ খাওয়ানোর অভিযোগ উঠেছে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার খান্দারপাড় ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা আলম শেখের বিরুদ্ধে। আর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নিজের বাবা মতিউর রহমানকে (৬০) রামদা দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেন মামুনুর রশিদ মামুন (৩০)। মামুন বগুড়ার শেরপুরের খানপুর ইউনিয়নের কয়েরখালী বাজার এলাকার বাসিন্দা। পুলিশ ও পরিবার সূত্রে জানা গেছে, মামুন মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘আগে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনাগুলো যৌতুক বা স্বামী-স্ত্রীর পরকীয়ার সম্পর্কের কারণে ঘটলেও এখন এর ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের মোবাইল আসক্তি বৃদ্ধির কারণে একটি পরিবারের সব সদস্যই এক ধরনের মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এতে পারিবারিক জটিলতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার মহামারীর কারণে অর্থনৈতিক ধস নেমেছে। অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে পারিবারিক জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। বাবার বাড়ি থেকে মেয়েদের সম্পত্তি না দেওয়ার মানসিকতার কারণেও সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। আবার কোনো কারণে স্বামীর মৃত্যুর পর মেয়েরা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ জটিলতায় অনেক নারী অনিরাপত্তা থেকে তার ছোট সন্তানসহ আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছেন। আবার স্বামীরা স্ত্রীকে পরকীয়ার জন্য সন্দেহ করছেন, যা জটিল এক মনস্তাত্তি¡ক সমস্যা তৈরি করছে। কিন্তু মনস্তাত্তি¡ক এ সমস্যা সমাধানে আমাদের পরিবার ও রাষ্ট্র থেকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে পারিবারিক সহিংসতা একের পর এক ঘটে চলেছে। আশঙ্কা করছি এ ঘটনাগুলো ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাবে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর