রবিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

জনপ্রতিনিধি-আমলা দ্বন্দ্বে সমালোচিত প্রশাসন

উবায়দুল্লাহ বাদল

জনপ্রতিনিধি-আমলা দ্বন্দ্বে সমালোচিত প্রশাসন

বিদায়ের পথে ২০২১। আলোচিত এই বছরে প্রশাসনও ছিল নানা ঘটনায় ভরপুর। বছরের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল বরিশালে জনপ্রতিনিধির সঙ্গে প্রশাসন কর্মকর্তার দ্বন্দ্ব। পাশাপাশি ছাগলের ফুল গাছ খাওয়া ও নারী কর্মকর্তাদের ‘আপা’ বলে সম্বোধন করার মতো তুচ্ছ ঘটনা কেন্দ্র করে প্রশাসন কর্মকর্তাদের আচরণেও আলোচনা-সমালোচনা ছিল বছরজুড়েই। চলতি বছরই সামনে আসে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়টি। এ ছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নথি গায়েবের ঘটনাও ছিল মানুষের মুখে মুখে। সাংবাদিক নিপীড়নের অভিযোগ প্রমাণিত হলেও কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীনের দন্ড মওকুফের ঘটনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে নারী অফিস সহকারীর সঙ্গে আপত্তিকর ভিডিও প্রকাশের ঘটনায় শাস্তি পেয়েছেন জামালপুরের সাবেক ডিসি আহমেদ কবীর। তবে এসবের পাশাপাশি করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে প্রশাসন। চার মাসের বেশি সময় বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাদের। এ সময়ও থেমে ছিল না কর্মকর্তাদের পদোন্নতি। সচিব থেকে উপসচিব পর্যন্ত ৬৫০-এর বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। করোনার কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রার্থীদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়সে ২১ মাস ছাড় দেওয়াও ছিল একটি ভালো উদ্যোগ। এ বছরই তথ্য মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়’ করা হয়। ভালো-মন্দ মিলিয়েই প্রশাসনের কেটেছে ২০২১ সাল।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামালে প্রশাসন : করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) সংক্রমণ ফের উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকায় চলতি বছরের ৫ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ১৪ এপ্রিল ভোর ৬টা পর্যন্ত লকডাউন (বিধিনিষেধ) দেওয়া হয়। তবে গণপরিবহন, মার্কেট খোলা রাখায় ছিল অনেকটাই অকার্যকর। পরে ১৪ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে আট দিনের কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হলে কয়েক দফায় শিথিলতাও আনা হয়। বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের মাধ্যমে করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যকর্মীদের পর প্রশাসনই ছিল অগ্রগামী। মাঠে কাজ করতে গিয়ে অনেকে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণও করেন।

বরিশালে ইউএনও-মেয়র দ্বন্দ্ব, বিবৃতি নিয়ে বিতর্ক : চলতি বছর বরিশালে ইউএনও-মেয়র দ্বন্দ্বের বিষয়টি ছিল প্রশাসনের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। ১৮ আগস্ট বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদ কম্পাউন্ডে শোক দিবসের ব্যানার অপসারণ কেন্দ্র করে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যে রাতভর সংঘর্ষ হয়। এ সময় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনিবুর রহমানের সরকারি বাসভবনে হামলা হয়। এ ঘটনার মামলায় সিটি করপোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে হুকুমের আসামি করা হয়। প্রতিক্রিয়া জানায় প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। তাদের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- ‘মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ও তার দুর্বৃত্ত বাহিনী সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের দিয়ে নানা প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন এবং সমস্ত জেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। অ্যাসোসিয়েশন এমন কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা জানায় এবং বরিশালের মেয়র যার অত্যাচারে সমগ্র বরিশালবাসী অত্যন্ত অতিষ্ঠ সেই সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর হুকুমেই এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে মনে করে। অ্যাসোসিয়েশন অবিলম্বে তার গ্রেফতার দাবি করছে এবং তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে।’ এ বিবৃতি রাজনীতিবিদ ও প্রশাসন কর্মকর্তাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। এ বিষয়ে মন্ত্রিসভায় আলোচনা হলে প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয় অধিকাংশ সচিবই এ বিবৃতির সঙ্গে একমত নন।

সমালোচিত কিছু ঘটনা : করোনা আক্রান্ত হয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব রওনক মাহমুদের মায়ের সেবায় এক উপসচিবসহ ২৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়িত্ব দেওয়ার ঘটনা বড় ধরনের সমালোচনার জন্ম দেয়। লিখিত নির্দেশনা দিয়ে ২৩, ২৪ ও ২৫ আগস্ট তিন দিনের জন্য চার শিফটে ২৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিধিনিষেধের মধ্যে ২ জুলাই চেম্বারে যাওয়ার পথে ডা. ফরহাদ কবির সাতকানিয়ার ইউএনও নজরুল ইসলামের চেকপোস্টে তল্লাশির মুখে পড়েন। ইউএনও ডা. ফরহাদের পরিচয় জেনেও জরিমানা করায় ভুক্তভোগী চিকিৎসক ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে আলোচনার ঝড় ওঠে। পরে ইউএনও নজরুল ইসলামকে ওএসডি করা হয়। ফুল গাছ খাওয়ার অভিযোগে ১৭ মে বগুড়ার আদমদীঘির ইউএনও সীমা শারমিন একটি ছাগলের মালিককে ২ হাজার টাকা জরিমানা করেন। জরিমানার নয় দিন পর মালিক সাহারা বেগমকে না জানিয়ে সেটি বিক্রি করার অভিযোগ ওঠে। পরদিন ২৭ মে সেই জরিমানার টাকা নিজে পরিশোধ করে ছাগলটি মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেন ইউএনও। পরে ইউএনওকে বদলি করা হয়। ৪ অক্টোবর কুমিল্লার বুড়িচংয়ের ইউএনও সাবিনা ইয়াছমিনকে ‘আপা’ বলে সম্বোধন করায় রেগে জামাল উদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ীকে ‘মা’ ডাকতে বলেন ওই ইউএনও। ভুক্তভোগী জামাল উদ্দিন বিষয়টি ফেসবুকে শেয়ার করলে মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়। ৩০ মে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা অনিরুদ্ধ দাশও একই আচরণ করেন। এক সাংবাদিক ‘স্যার’ না ডেকে ‘ভাই’ সম্বোধন করায় আপত্তি তোলেন তিনি। ৮ জুলাই মানিকগঞ্জের সিংগাইরের ইউএনও রুনা লায়লাকে ‘স্যার’ না বলে ‘আপা’ বলায় তার নির্দেশে এক ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ ওঠে সিংগাইর থানা পুলিশের বিরুদ্ধে।

সরকারি চাকুরেদের সম্পদের হিসাব ইস্যু : সরকারি চাকুরেদের (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) সম্পদের হিসাব দেওয়ার ইস্যুটি এ বছরই সামনে আসে। ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’ অনুযায়ী পাঁচ বছর পরপর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদ বিবরণী দাখিল এবং স্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা বিক্রির অনুমতি নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এ নিয়ম মানছেন না, এ বিষয়ে সরকারেরও কোনো তদারকি নেই। এ প্রেক্ষাপটে বিধিমালাটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সম্পদ বিবরণী দাখিল ও স্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা বিক্রির নিয়ম মানতে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিব/সচিবদের কাছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে চলতি বছরের ২৪ জুন চিঠি পাঠানো হয়। প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। তাই সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি নেই বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সূত্রে জানা গেছে।

উদ্ধার হয়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গায়েব নথি : স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ১৭টি নথি গায়েব বা খোয়া যাওয়ার বিষয়টি চলতি বছরে প্রশাসনের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। ২৮ অক্টোবর স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে নথি হারানোর বিষয়ে রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। এ ঘটনার ছায়াতদন্ত শুরু করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারা কয়েকজন কর্মচারীকে সিআইডি কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে। নথি গায়েবের ঘটনায় মন্ত্রণালয়টির অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) মো. শাহ্ আলমকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু গায়েব হওয়া ফাইল এখনো উদ্ধার হয়নি। তবে তদন্তের সুপারিশের আলোকে অভিযুক্ত চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

সাবেক ডিসি সুলতানার শাস্তি মওকুফ, লঘুদন্ড কবির : একজন সাংবাদিককে মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদন্ড দেওয়ায় কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনের দুই বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা হয়েছিল। সেই লঘুদন্ডও বাতিল করে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ২৩ নভেম্বর এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এর আগে ১০ আগস্ট সুলতানাকে দুই বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি স্থগিতের লঘুদন্ড দেওয়া হয়েছিল। এ ঘটনা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। অন্যদিকে নারী অফিস সহকারীর সঙ্গে আপত্তিকর ভিডিও প্রকাশের ঘটনায় জামালপুরের সাবেক ডিসি আহমেদ কবীরের বিরুদ্ধে ২৮ ফেব্রুয়ারি বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তার বেতন কমিয়ে প্রায় অর্ধেক করা হয় এবং তিনি চাকরিজীবনে কোনো পদোন্নতি পাবেন না।

 

সর্বশেষ খবর