সোমবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বিশেষ অভিযানেও থামছে না অস্ত্র চোরাচালান

বৈধ অস্ত্রের ডাটাবেজ করছে সিআইডি ও এসবি, অস্ত্রসহ গ্রেফতার অনেকেরই রাজনৈতিক-সংশ্লিষ্টতা, সীমান্তের ওপার থেকে ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে ঢুকছে অস্ত্র, ব্যবহার হচ্ছে আধিপত্য বিস্তার চাঁদাবাজি ও ইউপি নির্বাচনের খুনোখুনিতে

আলাউদ্দিন আরিফ

বিশেষ অভিযানেও থামছে না অস্ত্র চোরাচালান

সীমান্তের ৩০টির বেশি রুট দিয়ে বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্র ঢুকছে। দেশব্যাপী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেও অস্ত্রের চোরাচালান ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত আসছে ছোট-বড় আগ্নেয়াস্ত্র। দেশি-বিদেশি কারবারি মাধ্যমে সীমান্তের ওপার থেকে এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাত দিয়ে ঢুকছে অত্যাধুনিক অস্ত্র। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে প্রায়ই ধরা পড়ছে অস্ত্রবাহক কিংবা চোরাকারবারি। পাকড়াও কারবারি ও ব্যবহারকারী অনেকের রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে পুলিশি তদন্তে। অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, খুন-খারাবি, চুরি-ডাকাতিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে হামলা-পাল্টা হামলা ও খুনোখুনিতেও অবৈধ অস্ত্রের অবাধ ব্যবহারের তথ্য মিলছে। ইউপি নির্বাচনে আধিপত্য বিস্তারে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার রোধে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে সাত দিন টানা বিশেষ অভিযান চালায় পুলিশ। ৪৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারও হয়েছে। তবু বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালন।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (অপারেশন্স) হায়দার আলী খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সপ্তাহব্যাপী বিশেষ অভিযানের পরও অস্ত্র উদ্ধারে আমাদের এ অভিযান চলমান আছে। জেলা পুলিশ সুপার ও বিভিন্ন ইউনিটের প্রধানরা নিজ নিজ ইউনিটে এ বিশেষ অভিযান পরিচালনা ও তদারকি করছেন। অবৈধ অস্ত্রের কারাবার ও মাদক নিয়ন্ত্রণে পুলিশ জিরো টলারেন্স নিয়ে কাজ করছে।’ পুলিশ ও র‌্যাবের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, ‘অস্ত্রধারী কেউ গ্রেফতার হলে অস্ত্রের উৎস, কার হাত ঘুরে কোন পথে এসেছে, কার কাছে অস্ত্র যাচ্ছে এসব বিষয়ে জেরা করা হয়। জেরায় প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর রুট ও অন্যান্য কারবারি চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া দেশে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার রোধ এবং তাৎক্ষণিক তথ্য জানার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) দুটি আলাদা ডাটাবেজ তৈরির কাজ করছে। ডাটাবেজগুলো তৈরি হলে বৈধ-অবৈধ অস্ত্র চিহ্নিত করার কাজ সহজ হবে।

সম্প্রতি বিদেশি আটটি অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ ঢাকার গাবতলী থেকে গ্রেফতার হন পাঁচজন। যার নেতৃত্বে ছিলেন যশোরের শার্শা উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা আকুল হোসেন। ছয় বছরে দুই শর বেশি অস্ত্র সীমান্তের ওপার থেকে বাংলাদেশে এনে বিক্রির স্বীকারোক্তি দিয়েছেন তিনি।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যশোরের বেনাপোল ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ এ দুটি পয়েন্ট দিয়ে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র বাংলাদেশে আসার তথ্য আমরা বিভিন্ন সময় পেয়েছি। কিছুদিন আগে ঢাকার গাবতলী থেকে আটটি বিদেশি অস্ত্র, ১৬টি ম্যাগজিন, আট রাউন্ড গুলিসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন শার্শা উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা আকুল হোসেন। এ চক্রটির সীমান্তের ওপারে ভারতীয় অস্ত্র কারবারিদের সঙ্গে সাংকেতিক কথা বলার কিছু চ্যাটিং, ভিডিওকল রেকর্ডসহ নানা তথ্য আমরা পেয়েছি। তার থেকে ভারতের বেশ কিছু অস্ত্র কারবারির নাম পাওয়া গেছে। তার মধ্যে নারী অস্ত্র কারবারিও আছেন। এ চক্রটি ২০১৪ সাল থেকে ভারতের অস্ত্র এনে বিক্রি করছে।’ মশিউর রহমান আরও বলেন, ‘আমরা তাদের স্বীকারোক্তি থেকে জেনেছি মূলত বিহার ও মাদ্রাজ থেকে এসব অস্ত্র আনা হয়। তারা অস্ত্রকে ‘জিনিস’, গুলিকে ‘খাবার’, ইত্যাদি সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করে।’

ডিবির তদন্তে ছাত্রলীগ নেতা আকুল হোসেন ছাড়াও ইলিয়াস হোসেন ও আজিমুর রহমান আজিম, ভারতীয় কারবারি জামাল, পশ্চিমবঙ্গের দিহি কাশিপুরের রানা, দীপঙ্কর, সম্রাট, নিতাইসহ বেশ কয়েকজন শনাক্ত হয়েছেন।

মঙ্গলবার রাতে বেনাপোলের দিঘিরপাড় থেকে চারটি বিদেশি পিস্তল, ৩৮ রাউন্ড গুলিসহ গ্রেফতার হন অস্ত্র কারবারি আজিজুর রহমান ও আবদুল্লাহ। র‌্যাব-৬-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহাম্মদ মোসতাক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা আজিজুর রহমান ও আবদুল্লাহকে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে এনেছি। তারা বলেছেন স্থানীয় সহযোগী অন্য অস্ত্র কারবারিদের থেকে তারা বিক্রির উদ্দেশ্যে এসব অস্ত্র সংগ্রহ করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে এলাকায় নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও সংঘবদ্ধ অপরাধের অভিযোগও রয়েছে। রিমান্ডে অস্ত্রের উৎস ও অন্যান্য কারবারির বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।’

শুক্রবার রাজধানীর দারুসসালামে মনোয়ার হাসান জীবন নামে এক ব্যক্তিকে বিদেশি পিস্তল, ম্যাগজিন, এক রাউন্ড গুলিসহ গ্রেফতার করে র‌্যাব। অভিযানের নেতৃত্বে থাকা র‌্যাব-৪-এর মিরপুর ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ কামরুল সোহেল জানান, মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পাস মনোয়ার হোসেন জীবন ৩৩ বিসিএসের একজন চিকিৎসককে বিয়ে করেন। তিনি এলাকায় বিভিন্ন জনকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, প্রভাব বিস্তার ও চাঁদাবাজির জন্য অস্ত্র কেনেন। এর আগেও অস্ত্র মামলায় তার ১০ বছর সাজা হয়েছিল। র‌্যাবের আরেক কর্মকর্তা বলেন, জীবন স্থানীয়ভাবে সরকারদলীয় রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করতেন। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে। অস্ত্র নিয়ে কাজ করা একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো অর্থ জোগানের জন্য কিছু অস্ত্র দেশি সন্ত্রাসীদের কাছে বিক্রি করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানে একে-৪৭সহ নানা অস্ত্র উদ্ধার হয়। এ ছাড়া কক্সবাজারে মিয়ানমারের বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অস্ত্র এনে দেশি সন্ত্রাসীদের কাছে বিক্রি করে। পুলিশ সদর দফতদরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সমুদ্রপথ ব্যবহার করে অস্ত্র নিয়ে আসার তথ্য পেয়েছি আমরা। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, চাঁদপুর, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, মোংলা, খুলনা, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ দিয়ে তারা অস্ত্র চোরাচালান করে।’ এ ছাড়া বান্দরবান, রাঙামাটির সাজেক, খাগড়াছড়ির রামগড় ও সাবরুম, ফেনী, খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, উখিয়া, রামু, টেকনাফ, মহেশখালী, বাঁশখালী, রাউজান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, হিলি, লালমনিরহাটের বুড়িমারী, সিলেটের তামাবিল, জৈয়ন্তিয়াসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্র চোরাচালানের তথ্য পেয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। আবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, কক্সবাজারের চকোরিয়া, মুন্সীগঞ্জের দেশি অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পেয়েছে পুলিশ ও র‌্যাব। সীমান্তের কাছাকাছি একশ্রেণির বাসিন্দা অবৈধ অস্ত্র চোরাচালানে ব্যবহৃত হন। সীমান্তের ওপার থেকে কেনা আগ্নেয়াস্ত্রের মূল্য পরিশোধের টাকা লেনদেন হচ্ছে দুই সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় মোবাইল ব্যাংকিং, স্থানীয় এজেন্ট ও হুন্ডির মাধ্যমে।

সিআইডির ডাটাবেজ হচ্ছে : বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার রোধে একটি ডাটাবেজ তৈরি করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। অটোমেটেড ব্যালাস্টিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম (এবিআইএস) নামে বিশেষ সফটওয়্যারে দেশের সব বৈধ অস্ত্রের তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। গত মার্চে এ ডাটাবেজ তৈরির কাজ শুরু করে সিআইডি। সস্থাটির প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দেশের সব জেলার বৈধ অস্ত্রের তথ্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কাছে ও থানাগুলোয় বিচ্ছিন্নভাবে সংরক্ষিত আছে। এককভাবে কোথাও সংরক্ষণ করা নেই। এজন্য ডাটা ব্যাংক তৈরি করা হচ্ছে।’ সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, গত ১০ বছরে দেশে যত অস্ত্র বিক্রি হয়েছে তার যাবতীয় তথ্য অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছে চাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ আর্মস ডিলার অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে- এখন থেকে অস্ত্র বিক্রির সময় যত টেস্ট করা হবে সব টেস্টের নমুনা সিআইডিকে দিতে হবে। সিআইডি তা তাদের সফটওয়্যারে সংরক্ষণ করবে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রতিটি অস্ত্রেরই একটি ইউনিট ফিচার আছে। ওই ফিচারকে সিআইডির ডাটাবেজে সংরক্ষণ করে রাখা হচ্ছে। সিআইডি যখন কোনো ক্রাইম সিন সংগ্রহ করবে সেখানে গুলির ঘটনা ঘটলে প্রথমেই জানা যাবে অস্ত্রটি বৈধ না অবৈধ।

বিশেষ শাখার ডাটাবেজ : এদিকে দেশে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার রোধে অস্ত্র বিক্রয় ও লাইসেন্সিং পদ্ধতি একটি অটোমেশন সিস্টেমের অধীনে নিয়ে আসছে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)। সংস্থাটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিশেষ পুলিশ সুপার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘২২ মার্চ ফায়ার আর্মস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম নামে একটি সফটওয়্যার চালু করা হয়েছে যার মাধ্যমে আমরা সারা দেশের লাইসেন্স করা বৈধ অস্ত্রের তথ্যগুলো সংরক্ষণ করব। এ কাজ আগে ম্যানুয়ালি করা হতো।’ তিনি আরও বলেন, এ সফটওয়্যারটি দিয়ে প্রতিটি বৈধ গুলি ও আগ্নেয়াস্ত্র চিহ্নিত করা যাবে। এটি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ও বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার কমাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর