শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

জীবন-জীবিকার যুদ্ধ বছরজুড়েই

মানিক মুনতাসির

জীবন-জীবিকার যুদ্ধ বছরজুড়েই

দুই বছর আগে শুরু হওয়া করোনা মহামারীর আতঙ্ক কমলেও মৃত্যু এখনো থামেনি। ২০২০ সালের তুলনায় মৃত্যুহার ও সংক্রমণ কমেছে। ফলে চলতি বছরের শুরুতে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হওয়ায় জনগণের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি নেমে আসে। কিন্তু বছরের শেষ দিকে এসে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বজুড়ে। এটি আবার নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে জনজীবনে। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো ইতিমধ্যে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। করোনা মহামারীর কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছে। একই সঙ্গে বেশির ভাগ মানুষের আয় কমেছে। অথচ বছরজুড়েই পণ্যমূল্য ছিল অসহনীয়। চিকিৎসাসেবায়ও ছিল নানা রকমের হয়রানি আর অনিয়ম-দুর্নীতি। ফলে সারা বছরই মানুষ বেঁচে থাকার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করেছে। ভোজ্য তেল, চাল, ডাল, চিনি, পিঁয়াজসহ প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে বছরজুড়ে। এমনকি ডিম, চাষের মুরগি, মাছ ও সবজির বাজারও ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। বাজেট ঘাটতি আর ভর্তুকি কমাতে বছরের শেষ দিকে এসে বাড়ানো হয়েছে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম। এতে শুধু মানুষের পরিবহন খরচই বাড়েনি বরং জীবনধারনের বেলায় সব ধরনের খরচ বেড়েছে। ফলে করোনা মহামারী থেকে বাঁচতে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও স্বাস্থ্য পরিচর্যার খরচ বেড়েছে বছরজুড়েই। অথচ আয় বাড়েনি। আবার প্রয়োজনীয় খরচ দিয়েও কাক্সিক্ষত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে সাধারণ মানুষ। ফলে বছরজুড়েই মানুষকে জীবন-জীবিকার জন্য লড়তে হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিদায়ী বছরটায় করোনা আতঙ্ক কম ছিল। এখানে জীবনের চেয়ে জীবিকা নিয়েই মানুষকে বেশি যুদ্ধ করতে হয়েছে। শ্রমিক, দিনমজুর ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুয়ের আয় কমায় তারা ধার-কর্য করে জীবন চালিয়ে আসছেন যা মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি করেছে। অর্থাৎ বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মানুষ জীবন-জীবিকার জন্যই লড়াই করেছে।’ জরুরি নিত্যপণ্য হিসেবে পরিচিত  চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা-ময়দা, পিঁয়াজ ও আলুর দাম বেড়েছে হুহু করে। মাছ-মাংসের বদলে ডিম ও ব্রয়লার মুরগির মাংস খেত গরিব মানুষ। সেই ডিম ও ব্রয়লার মুরগিও বছরের শেষ দিকে তাদের নাগালের বাইরে চলে যায়। ফার্মের মুরগির ডিমের হালি কিনতে হয় ৪০ টাকায়। ১ কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ওঠে প্রায় ২০০ টাকায়। অথচ বছরের শুরু থেকে প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত ব্রয়লার মুরগির কেজি ছিল ১০০ থেকে ১১০ টাকা। ডিমের ডজন ছিল ৮০-৮৫ টাকা। নিত্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি সৃষ্টি করে ভোজ্য তেল, ডাল, চাল, আলু। ফলে ডাল আর ভর্তা ভাত খাওয়ায়ও মানুষ হিমশিম খেতে থাকে। এ কারণে নিত্যদিনের বাজার খরচ মেটাতে দিশাহারা হয়ে পড়েন নিম্নমধ্যবিত্তরা, যা এখনো বিদ্যমান। এতে আয়-ব্যয়ের তাল মেলাতে পারছেন না কিছুতেই। জীবন চালাতে ধার-কর্য করছেন প্রতিনিয়ত। ডাল-ভাত খেতে নাভিশ্বাস উঠেছে দিনমজুরদের। সাধারণ মানুষ এখনো লড়ছে জীবন-জীবিকার জন্য। এ ছাড়া ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে বিদায়ী বছরে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পিঁয়াজ ও ভোজ্য তেলের দাম। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে পিঁয়াজের দাম বাড়ে ৩৯ শতাংশ। এখনো দেশি পিঁয়াজের কেজি ৬০-৭০ টাকা। আর আমদানি করা ভারতীয় পিঁয়াজ ৫০ টাকা কেজি। এ সময় ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে ৯ শতাংশ। আর এক বছরের ব্যবধানে পণ্য দুটির দাম বেড়েছে ৫৩ শতাংশ পর্যন্ত। ১ লিটার সয়াবিন তেলের দাম এখন ১৫০-১৫৫ টাকা, যা এক মাস আগেও ছিল ১৩০-১৩৫ টাকা। আর এক বছর আগে ছিল ৯০-৯২ টাকা। ফলে বছরের ব্যবধানে ভোজ্য তেলের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এ ছাড়া জরুরি নিত্যপণ্য হিসেবে পরিচিত চালের দাম এক মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১১ শতাংশ। মোটা চালও এখন ৫০ টাকা কেজি। খোলা ও প্যাকেটজাত উভয় প্রকার আটা ও ময়দার দাম বেড়েছে ২ থেকে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত। প্যাকেটজাত আটার দাম এক মাসে বেড়েছে কেজিতে প্রায় ৭ টাকা আর খোলা ময়দার দাম কেজিতে বেড়েছে ১৬ টাকা পর্যন্ত। মহামারী করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে টানা লকডাউনের সময় কাজ হারায় অসংখ্য মানুষ। বেশির ভাগ কর্মজীবীর আয়ও কমে যায়। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রায় সব মানুষেরই নাভিশ্বাস ওঠে জীবন চালাতে। সংসার চালাতে না পেরে অনেকেই ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। মহামারী রূপ নেওয়া করোনাভাইরাস থেকে রেহাই পেতে রীতিমতো যুদ্ধ করছে বিশ্ববাসী। এর প্রভাবে বৈশি^ক অর্থনীতি ধসে পড়েছে। লোকসান গোনার আশঙ্কায় বড় অনেক কোম্পানি। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। আবার দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতি। সচল হয় সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য। কিন্তু কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসে না পণ্যমূল্য। বিশেষ করে চাল, ডাল, তেল, চিনি, মাছ, মাংস, পিঁয়াজ, রসুনের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সরকার দর বেঁধে দিলেও মানেনি কেউই। দীর্ঘ ভোগান্তির পর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নেমে এসেছে ২ শতাংশের নিচে। গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি ল্যাবরেটরিতে ১৯ হাজার ৬২৩টি নমুনা সংগ্রহ ও ১৯ হাজার ৬২৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ১ দশমিক শূন্য ৯৫ শতাংশ। কিন্তু এখন আবার নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ওমিক্রন। বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের ৪ কোটি পরিবার আছে। এর মধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ ভাগ আর উচ্চবিত্ত ২০ ভাগ। মাঝের যে ৬০ ভাগ এরা নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্ত। এ সংখ্যা আড়াই কোটি পরিবার হবে। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী, মাল্টিন্যাশনাল ও বড় কোম্পানিতে কাজ করা কিছু মানুষ বাদে অন্যরা সবাই এখন চরম সংকটে। এর বড় একটা অংশ চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে আছে। অনেকেরই নিয়মিত বেতন হয়নি, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। আবার যারা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করে তার বেশির ভাগই এখন কর্মহীন। এ ছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী মানুষেরা আরও বেশি কষ্টে রয়েছে। তাদের সংকট আরও অনেক বেশি। এ পরিস্থিতি চলতি বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় একই রকম রয়েছে। ফলে সারা বছরই মানুষকে যুদ্ধ করতে হয়েছে জীবন-জীবিকা নিয়ে।

সর্বশেষ খবর