মঙ্গলবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

আলোহীন আলোয় বেঁচে আছেন একই পরিবারের ১৯ জন

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

আলোহীন আলোয় বেঁচে আছেন একই পরিবারের ১৯ জন

গ্রামের নাম বালুয়া। নামের সঙ্গেই যেন মিল তাদের জীবনের। বালুর বাঁধের মতোই জীবন টেনে চলেছে অনিশ্চয়তার দিকে। তাদের কাছে দিন-রাত সমান। আলো নেই চোখে। আলোহীন হয়ে সংসার পরিচালনা করেন তারা। চোখের আলোহীন ১৯ জনের কেউ বৃদ্ধ, কেউ যুবক আবার কেউ বা শিশু। প্রত্যেকেই অন্ধ। অজানা কারণে বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার ছোট বালুয়া পূর্বপাড়া গ্রামে বংশপরম্পরায় অন্ধত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন পরিবারের সদস্যরা। ১৯ জন অন্ধ নিয়ে পরিবার চলছে নানা জটিলতায়।

জানা যায়, বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার             একটি গ্রামের নাম ছোট বালুয়া পূর্বপাড়া। এ গ্রামের মৃত তমির উদ্দিন মন্ডলের ছেলে আসাদুজামানের বয়স এখন ৮০ বছর। এ দীর্ঘ সময় তিনি অন্ধত্ব নিয়ে জীবনযাপন করছেন। সংসার চালিয়েছেন পথে পথে ভিক্ষা করে। একই পরিবারের অন্ধ ১৯ সদস্যের অন্যরা হলেন- ইদ্রিস আলী (৫৫), ইউনুস আলী (৪৮), এজেদা বেওয়া (৬০), মৃত মহির উদ্দিন মন্ডলের ছেলে নুরুল ইসলাম (৭০), আসাদুজামানের ছেলে মোশাররফ মন্ডল (৪০), মিটুল (৩৪), মেয়ে মোর্শেদা (৩৬), ইদ্রিস আলীর মেয়ে আশিনুর বেগম (২৫), তার ছেলে আজিজুর (১৬), ইউনুস আলীর মেয়ে সাবিনা বেগম (২৫), ফাতেমা (১০), সাবিনা বেগমের মেয়ে সুলতানা (৩), মৃত মুংলু মন্ডলের ছেলে সাহেব আলী (৩৫), তার মেয়ে শারমিন (১৩), সাহেব আলীর ছেলে শহীদ (১০), নুরুল ইসলামের ছেলে শরিফুল ইসলাম (৩০), মিটুলের মেয়ে মিতু খাতুন (১৩) ও ছেলে ইনসান। অন্ধ পরিবারের সদস্যরা চলেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজানের সুরে সুরে। ভোরে ফজরের আজানে ঘুম ভাঙে এই ১৯ জন্মান্ধের। তাদের মতে, প্রথম আজান হলে তারা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। ইশারায় হাঁটতে হাঁটতে রওনা দেন সোনাতলা রেলস্টেশনের দিকে। উদ্দেশ্য বগুড়াগামী ট্রেনে ওঠা। আবার কখনো কখনো বাসের উদ্দেশ্যে পৌঁছে যান বালুয়াহাটে। হাতড়ে হাতড়ে উঠে পড়েন ট্রেনে অথবা বাসে। বগুড়া শহরে নেমে শুরু হয় তাদের ভিক্ষাবৃত্তি। সারা দিন ঘুরে বেড়ান শহরের অলিগলি। আকুতি-মিনতি করে প্রার্থনা করেন ভিক্ষার। দিন শেষে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ঝুলি নিয়ে আবার পৌঁছে যান রেলস্টেশনে। গন্তব্য ফিরতি ট্রেনে বাড়ি যাওয়া। এভাবেই বংশপরম্পরায় চলছে তাদের জীবন। অন্ধ পরিবারের সদস্যরা জানান, তারা মূলত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান শুনে নিজেদের চালিয়ে নেন। জোহরের আজানে খাবার খাওয়া। আসরের আজানে নিজেদের ধীরে ধীরে বাড়ির পথে এগিয়ে নেওয়া। মাগরিবের আজান হলে ট্রেনের অপেক্ষা করা। এশার আজান হলে বাড়ি ফিরে খেয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া। আবার ফজরের সময় ওঠা। কথিত রয়েছে- প্রায় ২০০ বছরের এমন জন্মান্ধের জীবনচক্রে রয়েছে এ বংশ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এমন ঘটনার শিকার ওই পরিবারের দম্পতিরা যাপন করেন নানা জটিল সময়। পরিবারের অন্ধ ছেলে বিয়ে করেন অন্ধ নারীকে। আবার পরিবারের অন্ধ মেয়েকে বিয়ে দিলে ঘর টেকেনি অনেকের। সন্তানসম্ভবা মায়েরা সময় পার করেন চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে। তাদের ধারণা, অনাগত শিশুটিও হয়তো অন্ধ হয়ে জন্মাবে। একসময় সে ধারণাই বাস্তবে রূপ নেয়। আবার কখনো কখনো ভালো চোখ নিয়েও জন্ম নেয় তবে সে সংখ্যাও খুব কম। একই বংশে কেউ কেউ সাধারণ মানুষের মতো জন্ম নিলে তারা একসময় অন্ধদের দেখভাল করেন।

জন্মান্ধ এসব মানুষের এক-দেড় শতক করে বসতবাড়ির জায়গা ছাড়া আর কোনো ভিটেমাটি নেই। সেখানে ছোট্ট ছোট্ট ঘরে রাত কাটান হতভাগ্য মানুষগুলো। এ বংশের কেউ মারা গেলে কবরের জায়গার জন্য মুখাপেক্ষী হতে হয় অন্যদের। ভিক্ষাবৃত্তির আয় ছাড়া আর কোনো আয় না থাকায় জীবনযাত্রার মানও নিম্ন। প্রতিবন্ধী ভাতা ছাড়া আর কোনো সরকারি সহায়তা পান না বলে জানিয়েছেন এই জন্মান্ধরা।

 

জন্মান্ধদের বিষয়ে বালুয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান প্রভাষক রুহুল আমিন বলেন, ‘জন্মান্ধদের জন্য আমি প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। তাদের মধ্যে একজনের সরকারিভাবে বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, একজনকে ছাগল ও অন্য একজনকে ঢেউটিন দেওয়া হয়েছে। আমার ইচ্ছা আছে সমবায় সমিতির মাধ্যমে এদের পুনর্বাসনের।’ সোনাতলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাদিয়া আফরিন জানান, ‘সরকার সারা দেশেই প্রতিবন্ধীসহ অসহায় মানুষের কল্যাণে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তারা জীবনমান উন্নয়নে আগ্রহী হলে এবং ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়তে চাইলে তাদের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে। যদিও তাদের উপজেলা প্রশাসন থেকে বিভিন্ন সময়ে সহযোগিতা করা হয়েছে।’ সোনাতলা উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মিনহাদুজ্জামান লীটন বলেন, ‘ইতিমধ্যে একই বংশের জন্মান্ধদের কল্যাণে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়িয়ে সম্মানজনক কর্মকান্ডে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসন করা যেতে পারে। তাদের জন্য আমাদের উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে।’ জন্মান্ধ মানুষগুলো ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করুক। তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসুক সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। অন্ধকারেও তারা দেখুক কল্পিত আলো- এমন প্রত্যাশা এলাকাবাসীর। কিন্তু তাদের প্রতি মায়ার আঁচল বিছিয়ে না দেওয়ার কারণে এখনো চলছে ভিক্ষাবৃত্তি। কবে শেষ হবে বংশপরম্পরায় অন্ধ জীবন তা কেউ জানে না।

সর্বশেষ খবর