বৃহস্পতিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ডেল্টায় শুরু ওমিক্রনে শেষ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ডেল্টায় শুরু ওমিক্রনে শেষ

করোনাভাইরাস মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তাণ্ডবে বছরজুড়েই ছিল মৃত্যুর মিছিল। করোনার থাবায় এক দিনে ২৬৪ জনের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। করোনা ঠেকাতে দেশজুড়ে চলছে টিকাদান। কিন্তু বছর শেষে উৎকণ্ঠা বাড়ছে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন নিয়ে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস দুই বছর ধরে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় করে চলেছে। অসংখ্যবার মিউটেশন করে শক্তিশালী ভ্যারিয়েন্ট তৈরি করছে করোনা। নতুন ভ্যারিয়েন্ট ছড়াচ্ছে বিভিন্ন দেশ থেকে। আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ, বাড়ছে লাশের সারি। এ বছরের শুরুর দিকে দেশে করোনা সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে চলে আসে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে দেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩ কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি করে সরকার। ২১ জানুয়ারি দেশে পৌঁছে করোনার টিকা। ২৭ জানুয়ারি থেকে দেশজুড়ে শুরু হয় টিকাদান। রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তাকে দিয়ে শুরু হয় টিকাদান। মার্চের শুরু থেকেই ফের বাড়তে থাকে করোনা সংক্রমণ। প্রতিবেশী দেশ ভারতে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপে সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। দেশে এ ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়লে মার্চ থেকে বাড়তে শুরু করে রোগীর সংখ্যা। আক্রান্ত বাড়লে হাসপাতালগুলোতে স্থান সংকুলান হয়ে পড়ে। আইসিইউর জন্য রোগী নিয়ে হাসপাতালের দুয়ারে ঘুরতে থাকেন স্বজনরা। জুলাই-আগস্টে সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। ১০ আগস্ট এক দিনে করোনার সংক্রমণে ২৬৪ জন মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। রোগীর চাপ সামলাতে মহাখালী ডিএনসিসি মার্কেটকে কভিড হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হয়। গ্রামে-গঞ্জে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। উপসর্গ নিয়ে করোনা টেস্ট করতে আসা মানুষের ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয় পরীক্ষাগারে দায়িত্বরত কর্মীদের। নমুনার স্তূপ পড়ে যায় ল্যাবে।  ৬৪ জেলার অধিকাংশগুলোতেই আইসিইউ সাপোর্ট না থাকায় সংকটাপন্ন রোগীদের জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। ২২ জুন মাদারীপুর, গোপালগঞ্জসহ বেশ কিছু জেলায় লকডাউন ঘোষণা করা হয়। ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হয়। রোগী বাড়তে থাকলে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব কনভেনশন সেন্টারকে ফিল্ড হাসপাতালে রূপান্তরিত করে সেবাদান শুরু হয়। ভারতে সংক্রমণ বাড়ায় এপ্রিল থেকে টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় সে দেশের সরকার। কেনা টিকার মধ্যে ৭০ লাখ ডোজ এবং ভারত থেকে উপহার পাওয়া ৩৩ লাখ ডোজ টিকা আসার পর সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার চালান বন্ধ হয়ে যায়। এতে দেশের টিকাদান কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় চীনের কাছ থেকে টিকা কেনার চুক্তি করে সরকার। এ ছাড়া কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস (কোভ্যাক্স) থেকে টিকা সহায়তা চাওয়ার উদ্যোগ নেয় সরকার। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে টিকা সহায়তা পায় বাংলাদেশ। চীন থেকে ক্রয় চুক্তির আওতায় কেনা টিকা, কোভ্যাক্স থেকে পাওয়া এবং বিভিন্ন দেশ থেকে পাওয়া টিকায় গতি পায় টিকা কার্যক্রম। করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমতে থাকলে সেপ্টেম্বরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে পরিস্থিতি। ১২ সেপ্টেম্বর সীমিত পরিসরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়। ১ নভেম্বর করোনা থেকে সুরক্ষা দিতে দেশব্যাপী ১২-১৭ বছর বয়সী শিশুদের টিকা দেওয়া শুরু হয়। ২৩ নভেম্বর দেশীয় প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেকের তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা ‘বঙ্গভ্যাক্স’ মানুষের শরীরে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের অনুমতি দেয় বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা কাউন্সিল (বিএমআরসি)। এর আগে বানরের দেহে টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগে ভালো ফল পাওয়ার কথা জানিয়েছিল তারা। করোনা প্রতিরোধে দেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মডার্না, ফাইজার এবং সিনোফার্মের টিকা দিয়ে চলছে টিকাদান। এ পর্যন্ত দেশে প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছেন ৭ কোটি ২৪ লাখ মানুষ, দ্বিতীয় ডোজের টিকা নিয়েছেন প্রায় ৫ কোটি মানুষ। এর মধ্যে দেশে টিকা উৎপাদনের প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে। ইনস্পেটা, বেক্সিমকোসহ বেশ কয়েকটি দেশীয় ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি টিকা উৎপাদনে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সংযুক্ত করছে। চীন থেকে প্রযুক্তি এনে পুরোপুরি উৎপাদন করে অথবা চীনে উৎপাদিত টিকা বাল্কে এনে বাজারজাত করবে প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব অগ্রগতির মধ্যে গত ১১ ডিসেম্বর দেশে করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। জিম্বাবুয়ে ফেরত দুই নারী ক্রিকেটার করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। ওমিক্রন ঠেকাতে গত ১৯ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে করোনা টিকার তৃতীয় ডোজ অর্থাৎ বুস্টার ডোজ প্রদান। টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার ছয় মাস পার হয়েছে এমন ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি এবং সম্মুখসারির কর্মীদের বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত দেশে সাতজনের শরীরে করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফান্সসহ বেশ কিছু দেশে হুহু করে বাড়ছে ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ওমিক্রন ঠেকাতে দেশের বিমানবন্দর, স্থলবন্দর, নৌবন্দরে নেওয়া হয়েছে বাড়তি সতর্কতা। জোরদার করা হয়েছে স্ক্রিনিং কার্যক্রম। সংক্রমণ ব্যাপক হারে ছড়িয়েছে এমন নির্দিষ্ট কিছু দেশ থেকে আসা যাত্রীদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তাণ্ডবে শুরু হওয়া বছর শেষ হচ্ছে ওমিক্রনের চোখ রাঙানিতে।

সর্বশেষ খবর