সোমবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলার চ্যালেঞ্জের বছর

আলাউদ্দিন আরিফ

বিদায়ী ২০২১ সালে মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল ক্ষমতাসীন সরকারকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে পড়ায় বিদায়ী বছরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিস্থিতি তৈরি হয়। অনেক এলাকায় হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনাও দেখা যায়। মাদক নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন অভিযানের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা, বিরোধী নেতা-কর্মীদের নিপীড়ন, মামলা, রাজনৈতিক দল আশ্রিত মাস্তান বাহিনী প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন, গুলি, খুনোখুনি, নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে খুন-দাঙ্গাহাঙ্গামাসহ সহিংসতার বহু ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে দেশের মানুষ। বিদায়ী বছরে নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা ছিল অন্য সময়ের তুলনায় বেশি। ধর্ষণ, দলগত ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যার চাঞ্চল্যকর বেশ কিছু ঘটনাও দেখা যায় বিদায়ী বছরে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী বছরও মানবাধিকার রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। তাদের মতে, কোনো দেশের স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগ ও উন্নয়নের পূর্বশর্ত সুশাসন। সুশাসনের জন্য প্রয়োজন মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ। কারণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ইউনিফর্ম আছে, তাদের হাতে অস্ত্র আছে ও আইনের বই আছে; তারা সঠিক তদারকিতে না থাকলে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করতে পারে। এ ছাড়া পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িতরা জনগণের আস্থা, ভরসা ও বিশ্বাসের প্রতীক। তাদের হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে এবং ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ঘটলে ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি হতে বাধ্য। এর থেকে নেতিবাচক অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে। তাই সরকারের উচিত বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে মানবাধিকার রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো প্রতিকারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। বাহিনীতে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার নিয়ে আসা। বিরোধী দল, গণমাধ্যমসহ প্রেশার গ্রুপ হিসেবে যারা কাজ করেন তাদেরও মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে পরিকল্পনা তুলে ধরা উচিত। তা না হলে এক দল ক্ষমতায় আছে আরেক দল আসবে; কিন্তু সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটানো যাবে না।

জানা গেছে, দেশে ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে বিদায়ী ডিসেম্বর মাসের শুরুতে দেশের ১৫ ব্যক্তি ও ১০ প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ সরকারের মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ হিসেবে র‌্যাবের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ব্যাপক ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। এ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আইনের শাসনের প্রতি অবজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থ ও বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতিকে হুমকির মুখে ফেলছে।

ওই বিজ্ঞপ্তিতে ‘র‌্যাবের বিরুদ্ধে ২০০৯ সাল থেকে ৬০০টির বেশি গুম, ২০১৮ সাল থেকে ৬০০ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতনের অভিযোগ তোলা হয়।’ এতে আরও বলা হয়, ‘এসবের অধিকাংশ ঘটনা বিরোধী দলের কর্মী, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীদের ওপরও ঘটানো হয়েছে।’

এদিকে বিদায়ী বছরের ১৩ থেকে ২০ অক্টোবরের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ৯ জন নিহত ও কমপক্ষে দুই শতাধিক আহত হয়েছেন। কুমিল্লায় একটি পূজামন্ডপে পরিকল্পিতভাবে কোরআন রাখাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়ায়। হামলা, ভাঙচুর চালানো হয় অন্তত আটটি মন্দিরে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই ঘটনার ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়। চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী ও রংপুরে আক্রান্ত হয় হিন্দুদের ঘরবাড়ি, উপাসনালয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ওই সময় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ দাবি করেছিল, দুর্গাপূজার মধ্যে তিন দিনেই ৭০টি পূজামন্ডপে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ হয়। হামলা প্রতিরোধে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা ওঠে। তবে পুলিশ ৩৫ জেলায় ১৪২টি মামলায় গ্রেফতার করে ১ হাজার ১৩৬ জনকে। এদিকে গত ২৯ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সোসাইটি পিস ফর হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচআর) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহকে লম্বাশিয়া ক্যাম্পে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাকে হত্যার জন্য রোহিঙ্গাদের আরেকটি সংগঠন আরসার সদস্যদের দায়ী করে তার পরিবার। বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে ওই রোমহর্ষক হত্যাকান্ডের বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোচনায় আসে। স্বচ্ছ তদন্ত করে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়। ওই ঘটনার এক মাসের মাথায় কক্সবাজারের উখিয়ায় শরণার্থী শিবিরের এক মাদরাসায় হামলা চালিয়ে ছয়জনকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনায় কথিত আরসা নেতা মোহাম্মদ হাসিমের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আলোচনার মধ্যেই নভেম্বরের শুরুতে ক্যাম্পে তার লাশ পাওয়া যায়। তবে কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছে, সে বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে পরিষ্কার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাব মতে, বিদায়ী বছরের প্রথম ৯ মাসে মোট ৭১ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৫ জন মারা যান কথিত বন্দুকযুদ্ধে। নির্যাতনে ৫ জন, গুলিতে ৩০ জন ও পিটিয়ে হত্যা করা হয় ১ জনকে। কারাগারে মৃত্যু হয় ৫৪ জনের। বিএসএফ কর্তৃক গুলি করায় সীমান্তে মারা যান ১০ জন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয় ৯০ জনকে। তাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের পদস্থ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে উসকানি ছড়ানোর দায়ে ৮১ জনকে এবং ধর্ম, ধর্মীয় উসকানি ও কটূক্তির কারণে ৯ জনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়া বছরজুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের আরও বহু ঘটনা প্রত্যক্ষ করা গেছে।

সর্বশেষ খবর