বুধবার, ৫ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা
সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে আগুন

মালিক চালক মাস্টারকে দায়ী করে নৌ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন

১৭ সদস্যের নাগরিক তদন্ত কমিটি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকান্ডে হতাহতের ঘটনায় লঞ্চটির চারজন মালিক, মাস্টার ও চালকদের দায়ী করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কমিটি। সদরঘাটে কর্মরত নৌপরিবহন অধিদফতর ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা রয়েছে। নৌপরিবহন অধিদফতরের অনুমতি না নিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ডকইয়ার্ডে লঞ্চটিতে পুরনো ইঞ্জিন সংযোজন করার কারণে ডকইয়ার্ডের মালিককেও এ ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছে। গত সোমবার রাতে কমিটির আহ্বায়ক ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. তোফায়েল ইসলাম মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীর কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেন। দুর্ঘটনা রোধে ২৫ দফা সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এদিকে লঞ্চটিতে অগ্নিকান্ডের কারণ খুঁজে বের করতে ১৭ সদস্যের নাগরিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন আন্দোলন এবং নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটিসহ ১৫টি সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে গতকাল এ কমিটি গঠন করা হয়। মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি চাঁদপুর ঘাট অতিক্রম করার পর ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দেয়। ইঞ্জিনের ত্রুটি সারতে ব্যর্থ হওয়ায় লঞ্চটি আর না চালিয়ে নিরাপদ কোনো ঘাটে আগেই ভেড়ানো উচিত ছিল। অনেক যাত্রী লঞ্চটি ভেড়ানোর অনুরোধও করেছিলেন। কিন্তু মাস্টার ও ইঞ্জিনচালক এ বিষয়ে কর্ণপাত না করে ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চটি চালাতে থাকেন। লঞ্চে লাগা আগুন নেভানোর কোনো চেষ্টা করা হয়নি বলে উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, আগুন লাগার পর লঞ্চটির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় আনুমানিক ১৫ মিনিট চলার পর ঝালকাঠির ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের চর বাটারাকান্দা গ্রামে নদীর পাড়ে লঞ্চটি ভেড়ে। এখানেই লঞ্চের প্রথম শ্রেণির ইঞ্জিনচালক মাসুম বিল্লাহ, দ্বিতীয় শ্রেণির ইঞ্জিন ড্রাইভার আবুল কালাম ও কর্মরত গ্রিজাররা (ইঞ্জিনকক্ষের সহকারী) পালিয়ে যান। নোঙর করা বা লঞ্চটি বাঁধার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া সত্ত্বেও সে চেষ্টা করা হয়নি।

লঞ্চটি প্রথম যেখানে ভিড়েছিল, সেখানে নোঙর না করায় বা বেঁধে না রাখায় জোয়ারের কারণে সেটি আবার মাঝনদীতে চলে যায়। লঞ্চটি পুড়তে পুড়তে প্রায় ৪০ মিনিট পর নদীর অপর পাড়ের দিয়াকুল গ্রামে ভেড়ে। এ সময়ে অনেক যাত্রী অগ্নিদগ্ধ হন। অনেকে নদীতে লাফ দেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আগুন নেভানোর চেষ্টা করা হলে, লঞ্চটি চর বাটারাকান্দায় ভেড়ানোর স্থানে বাঁধলে বা নোঙর করলে হয়তো আগুনের তীব্রতা এত বৃদ্ধি পেত না। এত যাত্রীর প্রাণহানি ঘটত না।

আগুনের সূত্রপাত লঞ্চের ইঞ্জিন থেকেই হয়েছে উল্লেখ করে মালিকদের দায় নির্ধারণ করে কমিটি বলছে, নিবন্ধন সনদ অনুযায়ী লঞ্চটির দুটি ইঞ্জিনের মোট ক্ষমতা ছিল ১ হাজার ১০০ অশ্বক্ষমতার (বিএইচপি)। কিন্তু মালিকরা নৌপরিবহন অধিদফতরের অনুমতি না নিয়ে সনদের শর্ত ভেঙে অন্য জাহাজের পুরনো ৩ হাজার ৩৬ বিএইচপির ইঞ্জিন সংযোজন করেন। অভ্যন্তরীণ জাহাজ বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো নৌযানে ১ হাজার ২০ কিলোওয়াট বা ১ হাজার ৫০১ দশমিক ৯২ বিএইচপির চেয়ে বেশি ক্ষমতার ইঞ্জিন সংযোজন করলে লঞ্চে ইনল্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ার (আইএমই) নিযুক্ত করতে হয়। কিন্তু লঞ্চটিতে এ পদের কেউ ছিলেন না।

অভিযান-১০ লঞ্চের অগ্নিকান্ডের মতো দুর্ঘটনা রোধে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে ২৫টি করণীয় ও সুপারিশ উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম ‘রোটেশন’ প্রথা বন্ধ করা। এ ছাড়া রয়েছে প্রধান প্রধান নদীবন্দর অথবা ঘাট ছেড়ে যাওয়ার আগে (বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটি ও উৎসব উপলক্ষে যাত্রীর চাপের সময়) নৌপরিবহন অধিদফতর ও বিআইডব্লিউটিএর পরিদর্শকদের যথাযথভাবে যাত্রীবাহী লঞ্চ পরিদর্শন করা। ঘন ঘন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা। প্রয়োজনীয় সংখ্যায় জনবল বাড়ানো। লঞ্চের ইঞ্জিনকক্ষের আগুন নেভানোর জন্য স্থায়ী কার্বন ডাই-অক্সাইড সিস্টেম থাকা বাধ্যতামূলক করতে বলেছে কমিটি।

১৭ সদস্যের নাগরিক তদন্ত কমিটি : লঞ্চে অগ্নিকান্ডের কারণ খুঁজে বের করতে ১৫টি সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে গতকাল এ কমিটি গঠন করা হয়। রাজধানীর ধানমন্ডির কলাবাগানে পবা কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির চেয়ারম্যান আবু নাসের খান এই কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, কমিটি আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। নাগরিক তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে আবু নাসের খানকে। কমিটির সদস্যসচিব ও প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছেন যথাক্রমে নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্য সচিব আমিনুর রসুল এবং লেখক ও নৌপরিবহন বিষয়ক গবেষক আশীষ কুমার দে।

কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে রয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মীর তারেক আলী, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক ও যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোর ভি শিপস-এর সাবেক প্রধান নৌ প্রকৌশলী মো. আবদুল হামিদ। এ ছাড়া নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি হাজী মোহাম্মদ শহীদ মিয়া, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, বিআইডব্লিউটিএর সাবেক সচিব সৈয়দ মনোয়ার হোসেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নিশাদ মাহমুদ, নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরামের (নাসাফ) সাধারণ সম্পাদক মো. তৈয়ব আলী, কোস্ট ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল আকন্দ, বাপার যুগ্ম সম্পাদক মিহির বিশ্বাস, বিআইডব্লিউটিএর সাবেক কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ ও পুরান ঢাকা পরিবেশ উন্নয়ন ফোরামের আহ্বায়ক মো. নাজিম উদ্দিন তদন্ত কমিটির সদস্য হিসেবে আছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর