মঙ্গলবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

নগরজুড়ে পার্কিং নৈরাজ্য

ঢাকার ৩০ শতাংশ যানজটের জন্য দায়ী অবৈধ পার্কিং, নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা, বাড়ছে ভোগান্তি

জিন্নাতুন নূর

নগরজুড়ে পার্কিং নৈরাজ্য

মিরপুর ১২-তে রাস্তায় পার্কিং করা হয়েছে গাড়ি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ঢাকাজুড়ে চলছে পার্কিং নৈরাজ্য। যার যেমন খুশি যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করছে। এতে শুধু শহরের প্রধান সড়কই নয়, অলিগলিও এখন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে নগরবাসীকে। রাস্তার দুই পাশে বাস ও গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে দুর্ঘটনাও ঘটছে। আবার অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে সৃষ্ট যানজটে ঢাকাবাসীর মূল্যবান কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, পড়তে হচ্ছে দুর্ভোগে। বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক জরিপে জানা যায়, শহরে ৩০ শতাংশ যানজটের জন্য দায়ী অবৈধ গাড়ি পার্কিং। আর এ জন্য প্রতি বছর অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতি হচ্ছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ পার্কিংয়ের বিষয়টি এখনই বিষফোঁড়া হয়ে উঠছে। কাজেই দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে এটি ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।

নগরীর ব্যস্ত এলাকার প্রধান সড়ক, শপিং মল ও সুপার মার্কেটের সামনে গড়ে উঠেছে অবৈধ গাড়ি পার্কিং। বিশেষ করে শপিং মলের সামনের রাস্তার ওপর কিছু সুবিধাভোগী চক্র অর্থের বিনিময়ে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা গড়ে তুলছে। আবার বড় শপিং মলগুলোর পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকাগুলোর সামনের রাস্তাঘাটেও পার্কিং নৈরাজ্য চোখে পড়ার মতো। বিয়েবাড়ি, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও মেলার মতো আয়োজনেও পার্কিংয়ের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় ঢাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, মিরপুর ১২ নম্বর সিরামিকস-সংলগ্ন রাস্তাটিতে সারি সারি বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির বাস পার্ক করে রাখা থাকে দিনরাত। এতে করে এ এলাকায় প্রধান সড়কটির অধিকাংশই এখন বাসগুলোর দখলে চলে গেছে। বিভিন্ন সময় গাড়ি চলাচল বৃদ্ধি পেলে সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া নগরীর মতিঝিল, শাপলা চত্বর, সেগুনবাগিচা, গুলিস্তান, নয়াপল্টন, কাকরাইল, মগবাজার, ফার্মগেট, তেজগাঁও, বনানী, ধানমন্ডি, গুলশান, বাড্ডা ও নতুনবাজার এলাকার রাস্তার ওপর যত্রতত্র পার্ক করে রাখা হয় অসংখ্য ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল, পিকআপ ও সরকারি-বেসরকারি বাস। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য জায়গা প্রয়োজন ২৫ ভাগ কিন্তু আছে মাত্র ৮ ভাগ। আবার বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি বলছে, যারা সড়কে গাড়ি নামান তারা অনুমোদন নেওয়ার সময় নিজস্ব পার্কিং জোন দেখান। কিন্তু পরে সেসব স্থানে গাড়ি পার্ক করা হয় না। সংশ্লিষ্টরা বলেন, রাজধানীর পার্কিং নৈরাজ্য কমাতে ২০০৭ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন মহাপরিকল্পনা হাতে নিলেও সেটি এখনো বাস্তবায়ন করা যায়নি। পার্কিং নৈরাজ্য নিয়ে বিভিন্ন সময় একাধিক সংস্থা কাজ করলেও এর কোনো সমাধান মেলেনি। আবার ঢাকায় ভবন নির্মাণকালে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্যও পর্যাপ্ত জায়গা রাখা হচ্ছে না। আর এ বিষয়ে সিটি করপোরেশন ও রাজউকসহ সংশ্লিষ্টরা সেভাবে নজরদারি করছে না। অনেক স্থানে সুবিধামতো পার্কিং না পেয়ে চালকরা যত্রতত্র গাড়ি পার্ক করছেন। পার্কিং ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বহুতল কার পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বিশেষজ্ঞরা জানান, যত্রতত্র পার্কিংয়ের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, এটি যানজটের মূল উৎস। অনেক সময় গাড়িচালক যখন রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করে অন্যমনস্ক হয়ে বের হন তখন দুর্ঘটনায় পড়েন এবং এতে পথচারীও দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পান না। তারা আরও বলেন, ঢাকায় যদি প্যাটানোস্টার পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে জায়গাও কম লাগবে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ সময়ে দুটি গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য যে স্থান লাগে, প্যাটানোস্টার পদ্ধতিতে একসঙ্গে সেই জায়গাতেই ২০টি গাড়ি পার্ক করা যাবে। আর এ পদ্ধতিতে খরচও কম। যেহেতু ঢাকায় জায়গা কম এ পদ্ধতিটি কাজে আসতে পারে। সড়ক তৈরির জন্য অনেক অর্থ খরচ হচ্ছে কিন্তু পার্কিংয়ের বিষয়টি এখনো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে না। যানবাহন বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পার্কিং অব্যবস্থাপনার কারণে অনেক সময় রাস্তার মধ্যে পার্কিংয়ের জন্য চালক জায়গা খুঁজতে থাকেন। এ অবস্থায় একদিকে যেমন অতিরিক্ত জ্বালানি অপচয় হয়, অন্যদিকে রাস্তায় চলাচলকারী অন্য গাড়িগুলোর জন্য তৈরি হয় প্রতিবন্ধকতা। আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায় একটি নেতিবাচক দিক থেকে যাবে, যদি আমরা পার্কিং ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে না পারি। নগরে ব্যক্তিগত গাড়ি যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে ২০৩৫ সালে ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য গুলশান ও বনানী এলাকার মতো সমান জায়গার প্রয়োজন হবে শুধু পার্কিংয়ের জন্য। সে হিসাবে শুধু ৪০০ কিলোমিটার সড়ক লাগবে পার্কিংয়ের জন্য। আর ঢাকায় মূল সড়কই আছে ৪০০ কিমি। এ জন্য ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি পার্কিং নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর