বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

পার্সেল ফাঁদে এক বছরে ৩৫ জন

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিদেশি পার্সেলের প্রলোভনে প্রতারণার ফাঁদে গত এক বছরে পা দিয়েছেন অন্তত ৩৫ জন। ফাঁদে ফেলে এদের বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেছেন সাত নাইজেরীয় ও দুই বাংলাদেশি। ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে রাজধানীর পল্লবী, রূপনগর ও দক্ষিণখানে বাসা ভাড়া নিয়ে প্রথমে গার্মেন্ট ব্যবসা শুরু করেন ওই বিদেশিরা। এরপর ব্যবসার আড়ালে দেশি প্রতারকদের সহযোগিতায় চালান অভিনব প্রতারণা। এদের অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ।

গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব জানান র‌্যাব-৪-এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক।

তিনি জানান, অভিযুক্ত বিদেশি নাগরিকরা প্রথমে মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো কিংবা ফেসবুকে নিজেদের পশ্চিমা দেশের নাগরিক    পরিচয় দেন। এরপর বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। দামি উপহার, পার্সেল, অতিমূল্যবান সামগ্রী দেওয়ার কথা বলে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সাত বিদেশিসহ সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক চক্রের নয় সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, ‘এর আগে টাকা ডলারে রূপান্তর ও পার্সেল পাঠিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মাদকসহ ১৫-২০ জন বিদেশি নাগরিককে আটক করে র‌্যাব-৪। সম্প্রতি আমরা আবারও তথ্য পাই একই কায়দায় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে দামি উপহার পাঠানোর প্রলোভনে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ চক্র। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টা থেকে আজ (বুধবার) সকাল ৭টা পর্যন্ত র‌্যাব-৪-এর একটি দল র‌্যাব-৮-এর সহযোগিতায় রাজধানীর পল্লবী, রূপনগর ও দক্ষিণখানে অভিযান চালায়। এ সময় ৮টি পাসপোর্ট, ৩১টি মোবাইল ফোন, ৩টি ল্যাপটপ, ১টি চেক বই, ৩টি পেনড্রাইভ, নগদ ৯৫ লাখ ৮১৫ টাকাসহ নয়জনকে গ্রেফতার করা হয়।’ গ্রেফতারকৃতরা হলেন- নাইজেরীয় উদেজে ওবিন্না রুবেন, তার স্ত্রী দক্ষিণ আফ্রিকার এনটোম্বিখোনা গেবুজা, নাইজেরীয় ইফুন্যা ভিভিয়ান নাবুইকে, সানডে শেডেরাক এজিম, চিনেদু মোসেস নাজি, কলিমস ইফেসিনাসি তালিকে ও চিদিম্মা এবেলে আইলোফো। বাংলাদেশের দুজন হলেন- ফেনীর নাহিদুল ইসলাম ও তার স্ত্রী নরসিংদীর সোনিয়া আক্তার। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে- প্রথমে এরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেয়েদের নামে ভুয়া আইডি খুলে বিভিন্ন প্রোফাইল ঘেঁটে ঘেঁটে বড় বড় ব্যবসায়ী, হাই প্রোফাইল চাকরিজীবীসহ উচ্চবিত্ত মানুষদের টার্গেট করে। এরপর তাদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে। টার্গেট ব্যক্তির কাছে নিজেকে পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশের সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দেয়। ভুক্তভোগীকে বিভিন্ন সময়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ভুয়া ছবি পাঠায় বিশ্বাস স্থাপনের জন্য। সম্পর্কের একপর্যায়ে বিভিন্নভাবে ভুক্তভোগীকে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে প্রলুব্ধ করে। সম্পর্ক গড়ে তোলার পর প্রতারকরা তাদের কাছে থাকা বিপুল পরিমাণ ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা ভুক্তভোগীদের কাছে পাঠাতে চায় এবং বলে- ‘তোমার কাছে রেখে দাও, পরে নেব’। চাকরিজীবীদের বলে- জনসেবামূলক কাজে প্রচুর অর্থ ব্যয় করবে এবং এতে তারা একটি নির্দিষ্ট হারে কমিশন পাবে। আর যারা ব্যবসায়ী তাদের ক্ষেত্রে ব্যবসায় অর্থ লগ্নি করার কথা বলে এবং ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ কমিশন দেওয়া হবে বলে জানায়। এতে সহজ সরল মানুষ প্রলুব্ধ হয়ে তাদের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে প্রতারিত হয়। মোজাম্মেল হক বলেন, গ্রেফতার সোনিয়া আক্তার ও নাহিদুল ইসলাম আন্তর্জাতিক এ চক্রের দেশি সহযোগী। মূলত তাদের মাধ্যমেই প্রতারক চক্রের বিদেশি নাগরিকরা টার্গেট নির্ধারণ, বন্ধুত্ব স্থাপন, কাস্টমস অফিসার পরিচয় দেওয়া এবং শেষে অর্থ সংগ্রহ করে আসছিলেন। গ্রেফতার নাইজেরীয় উদেজে ওবিন্না রুবেন ২০১৭ সালে ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন এবং ২০২০ সালে তার নামে র‌্যাব-৪ প্রতারণা মামলা করে। এরপর তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। তিনি গার্মেন্ট ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেন। প্রকৃতপক্ষে প্রতারণাই তার পেশা। দক্ষিণ আফ্রিকার এনটোম্বিখোনা গেবুজা ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন। তার ভিসার মেয়াদ এ বছরের জুন পর্যন্ত। তিনি নিজেকে রুবেনের স্ত্রী পরিচয় দেন। আর নাহিদুল ২০০৮ সালে ঢাকার একটি স্কুল থেকে এসএসসি ও ২০১০ সালে একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। পরে রেস্টুরেন্ট ও একটি কল সেন্টারে কাজ করেন। ২০১৭ সালে ফ্যাশন ডিজাইন বিষয়ে ডিপ্লোমা করেন। ২০১৮ সালে মালয়েশিয়া গিয়ে গত বছর ফিরে আসেন। সোনিয়া ২০০৬ সালে ঢাকার একটি স্কুল থেকে এসএসসি ও ২০০৮ সালে এইচএসসি পাস করেন। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত একটি অ্যাম্বাসিতে ২৫ হাজার টাকা বেতনে চুক্তিতে চাকরি করেন। ২০১৮ সালের শেষের দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাইজেরীয় রুবেনের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয়ের পর এ প্রতারক চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। প্রতারণার কাজে সহযোগিতার জন্য রুবেন ভুক্তভোগীপ্রতি ২৫ শতাংশ অর্থ সোনিয়াকে দিতেন। সোনিয়ার নামে দক্ষিণখানে একটি চার তলা বাড়ি ও প্রাইভেট কার আছে। সোনিয়া ও নাহিদুল রুবেনের সঙ্গে উত্তরার জসীমউদ্দীনে মাসে ও সপ্তাহে দু-তিন বার দেখা করতেন। গত এক বছরে ৩০-৩৫ জন ভুক্তভোগীকে প্রতারিত করে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন সোনিয়া।

সর্বশেষ খবর