রবিবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

এক ব্রিজের অভাবে থমকে গেছে সব

নাজমুল হুদা, সাভার

এক ব্রিজের অভাবে থমকে গেছে সব

সাভারে একটি ব্রিজের অভাবে একটি ইউনিয়নের ২২ গ্রামের প্রায় ৩ লাখ মানুষের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। কোনোমতে ডিঙি নৌকা দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছেন তারা। গ্রামবাসী খেয়াঘাটে চাঁদার বিনিময়ে তুরাগ নদ পার হন। তবু একটি ব্রিজ করতে এগিয়ে আসেনি কেউ। ঢাকার লাগোয়া কাউন্দিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা বৃদ্ধ আলী মিয়া। তার মতো প্রায় ৩ লাখ মানুষের স্বপ্ন থমকে আছে একটি ব্রিজের অভাবে। ব্রিজের স্বাদ নৌকাতেই মেটাতে হচ্ছে কাউন্দিয়াবাসীকে। গাবতলী বেড়িবাঁধের শিরনীরটেক, দিয়াবাড়ী ও মিরপুর বেঁড়িবাধ দিয়ে তুরাগ নদ পার হলেই কাউন্দিয়া ইউনিয়ন। চারদিক নদবেষ্টিত কাউন্দিয়া তুরাগ নদের বুকে জেগে ওঠা ছোট্ট একটি দ্বীপ, যা কালের বিবর্তনে জনবহুল এলাকায় পরিণত হয়েছে। ঢাকা ও সাভারের সীমান্ত এলাকা এটি। ২০০ বছরের বেশি বয়সী কাউন্দিয়ার আয়তন ১১ দশমিক ৪৭ বর্গমাইল। ২২টি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত কাউন্দিয়া ইউনিয়ন, যার চারদিক জলবেষ্টিত। নৌকাই একমাত্র যাতায়াতের বাহন।  কয়েক শ গজ প্রশস্তের তুরাগ নদ পার হতে নৌকায় সময় লাগে ৭-১০ মিনিট, যা ব্রিজ হলে এক মিনিট লাগার কথা। অল্প কয়েক মিনিটের সংযোগস্থলটির কারণে কাউন্দিয়াবাসীর কান্না থামছে না। একটি ব্রিজের অভাবে যেন সব কিছু থমকে আছে। ব্রিজের কারণে এই ইউনিয়নের মানুষের উন্নত জীবন স্বপ্নবন্দি। নানা সমস্যায় জর্জরিত এখানকার জনজীবন। প্রতিদিন ভোর থেকেই কাউন্দিয়া-দিয়াবাড়ির ঘাটে দীর্ঘ লাইন ধরে নৌকার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হয় অফিস ও স্কুলগামী কাউন্দিয়াবাসীকে। নৌকা পারাপারের একমাত্র অবলম্বন হওয়ায় নির্দিষ্ট সময়ে কোমলমতি শিশুরা স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না। ছোট নৌকায় করে পারাপার হতে গিয়ে অনেক সময় কোলের শিশুসহ নদীতে পড়ে গেছেন অনেক বাবা-মা। নদীর পানি যখন নেমে যায়, গার্মেন্ট ও ট্যানারির বর্জ্যে উৎকট গন্ধ হয় নদীতে। নৌকায় করে চলাচল করা এখানকার মানুষের কষ্টকর হয়ে পড়ে। এভাবেই প্রতিদিন গড়ে ৭০ হাজার মানুষ নৌকায় যাতায়াত করেন। কাউন্দিয়া-দিয়াবাড়ী ঘাটটি এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক বছরে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে এ ঘাটে। তুরাগ ও আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় নদী ও বিভিন্ন খানাখন্দ ভরাট করতে বালিবাহী জাহাজ চলাচলের একমাত্র পথ এই তুরাগ নদ। প্রতিদিনই কয়েক সহস্রাধিক বালির জাহাজ এ পথে যাতায়াত করে। এসব বালিবাহী জাহাজের সঙ্গে যাত্রীবাহী নৌকার ধাক্কা খেলে শিশুসহ বহু মানুষ প্রাণ হারায়। সর্বশেষ গত বছর ৯ অক্টোবর সাভারে তুরাগ নদে আমিনবাজার এলাকায় বালুভর্তি দুই বাল্কহেডের চাপায় নৌকাডুবির ঘটনায় ছয়জন মারা যায়। স্থানীয়রা জানান, গত ১০ বছরে এখানে শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এত দুর্ঘটনা ঘটার পরও ব্রিজটি নির্মাণ না হওয়ায় কাউন্দিয়াবাসীর দুঃখের শেষ নেই। বিগত নির্বাচনগুলোতে ব্রিজটি নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েও কেউ কথা রাখেনি। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা বহু চেষ্টা করেও ব্রিজ নির্মাণে সফলতা পাননি।

স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, একটি প্রভাবশালী মহল ব্রিজ নির্মাণের বিরোধিতা করে আসছে। ব্রিজটি না হওয়ায় তারা ঘাট ইজারার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তাদের হাতে কাউন্দিয়াবাসীর উন্নয়ন বন্দি হয়ে আছে।

স্থানীয়রা জানান, সাভার উপজেলার এই ২২টি গ্রামে মানুষকে নদী পার হয়েই যেতে হয় শহর, হাটবাজার, অফিস-আদালত ও স্কুল-কলেজে। বছরের পর বছর ধরে বর্ষাকালে ও শুকনো মৌসুমে নৌকা দিয়ে তুরাগ নদ পার হন তারা। ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করলেও সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেননি কোনো জনপ্রতিনিধি বা স্থানীয় প্রশাসনের কেউ। সুমি আক্তার নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ব্রিজের অভাবে নদী পারাপারে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়। প্রতিদিন স্কুলে যেতে নৌকার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এ কারণে ঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছাতে পারি না।’ ব্যবসায়ী আব্বাস আলী বলেন, ‘উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রি করতে হাট-বাজারে যেতে হয়। কিন্তু মালামাল বোঝাই করে নৌকায় নদী পার হতে হয় আমাদের। এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বিকল্প কোনো পথ নেই। কাউন্দিয়া গ্রামের ব্যবসায়ী আসলাম উদ্দিন বলেন, ‘এখানে প্রতি বছর  নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি থইথই করে। তখন ছোট ছোট নৌকা পার হতে ভয় লাগে। ইউনিয়নে একটি ব্রিজ নির্মাণ হলে এই ২২ গ্রামের মানুষ উপকৃত হতো। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা মেছের আলী বলেন, এখানে ২৫০০-এর মতো ছোট নৌকা আছে। প্রয়োজনের সময় ঝুঁকি নিয়েই পার হতে হয় তুরাগ নদ। যে কোনো সময় নৌকা ডুবে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কাউন্দিয়া এলাকার বাসিন্দা ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী মনোয়ার হোসেন জানান, ‘প্রতিদিনই আমাকে কলেজ ও পারিবারিক কাজে দিনে কয়েকবার নৌকা পাড়ি দিতে হয়। নৌকা ভাড়ার সঙ্গে গুনতে হয় টোলের টাকা। নদী পার হতে গিয়ে বহুবার বইপত্রসহ পানিতে পড়ে গেছি। ব্রিজটি থাকলে এ এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা বদলে যেত।’ দিনমজুর ফরিদ মিয়া বলেন, ‘আমি গাবতলী এলাকায় রিকশা চালাই। কম ভাড়ায় থাকার জন্য ১১ বছর আগে কাউন্দিয়ায় বাসা নিয়ে থাকি। এখনো প্রতিদিন আমাকে চারবার করে নৌকায় যাতায়াত করতে হয়। ব্রিজ না থাকায় রিকশা নদের ওপারে তালা মেরে আসতে হয়। আর সব সময় ভয়ে থাকি কখন রিকশা চুরি হয়ে যায়। রিকশা চুরি হলে আমার ছেলেমেয়েদের না খেয়ে থাকতে হবে। ব্রিজটি হলে চিন্তা করতে হতো না।’ এ প্রসঙ্গে কাউন্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ব্রিজটি নির্মাণ হলে এই ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ এর সুফল ভোগ করবে। শিগগিরই যাতে ব্রিজটি নির্মাণ হয় সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’ ঢাকা-১৯ আসনের সংসদ সদস্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সীমানা ঘেঁষে নদীর অবস্থানের কারণে ব্রিজ নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতা। তবে আর কোনো আশ্বাস বা প্রতিশ্রুতি নয়; হাজারো মানুষের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে দ্রুত একটি স্থায়ী ব্রিজ নির্মাণ করা হবে। ইতোমধ্যে ব্রিজ নির্মাণে বরাদ্দ চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই ব্রিজের নির্মাণ কাজ শুরু করা হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর